13.7 C
Toronto
শনিবার, মার্চ ১৫, ২০২৫

মধ্যপ্রাচ্য থেকে টরন্টো : তিন

মধ্যপ্রাচ্য থেকে টরন্টো : তিন

তারপর গেলাম কারবালাতে । সেখানে হাসান হোসেইনের বাড়ি ছিলো এবং সেখানেই কারবালার যুদ্ধ হয়েছিল। উনাদের বাড়ী ও দেখলাম। সে সকল বাড়ীগুলো ছিলো একে বারে ভিন্ন ধরনের মাটির দেয়াল দেয়া।
বেশ বড় সর একটা ট্যুর দিয়ে মনটা ফ্রেস করে ফিরে আসলাম আমাদের বসরা শহরে ।

- Advertisement -

এর মাঝে রাজ্জাক ভাইরা চলে গেছেন পাশের দেশে কুয়েতে কাজের চুক্তি শেষ করে। তখন বড্ড একা লাগা শুরু হলো । যদিও তখন আমাদের অনেক বন্ধু বান্ধব হয়ে গিয়েছিলো ।

বেশ কিছুদিন যাবত ইরাক আর ইরান নিয়ে ঝামেলা শুনা যাচ্ছিলো । অবশেষে ইরাক ইরানে যুদ্ধ লেগেই গেলো । আমরা সবাই আতংকে অস্থির। মাঝে মাঝে সাইরেন শোনা গেলেও যুদ্ধের কোনো আলামত আমরা বুঝতে পারলাম না। যাই হোক আমাদের জানালো হোল আমাদের কোয়াটারের পাশ টা তেমন নিরাপদ না আমাদের নদীর ওপারে সরে যেতে হবে। আমাদের উপর আকাশ ভেংগে পড়লো । আমরা সাতেল আরব নদীর ওপারে বাসা ভাড়া করলাম। তখন আমি আমার দেহে নতুন প্রানের সারা পাচ্ছিলাম।

কিন্তু নদীর ওপারে যাবার পরে মনটা অনেক ভালো হয়ে গেলো । আমার বয়েসই দুইজন মহিলা পেয়ে গেলাম ওরাও নতুন বিয়ে হয়ে এখানে এসেছে আমাদের নতুন বাসার খুব কাছেই ওদের বাসা হেটে হেঁটেই চলে আসা যায় । প্রায় দিনই আসা যাওয়া গল্প আড্ডা চলে। মনে হচ্ছিলো আবার যেনো ছাত্র জীবনে ফিরে গেছি। যুদ্ধ নিয়ে আমাদের খুব একটা চিন্তা ছিলো না। কিন্তু আমার শরীর আস্তে আস্তে একটু একটু করে খারাপ হতে লাগলো । আমার বরের ইউনিভারসিটও সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা হোল ছাত্রদের নিরাপত্তার জন্য। তখন আমরা আমার এই অবস্থাতে বসরাতে থাকার সাহস পেলাম না। আমরা ঢাকা চলে এলাম।

ঢাকাতেই আমাদের মেয়ের জন্ম হোলো । তার মাস খানেক পরেই বসরা ইউনিভারসিটি খুলে গেলো ।যুদ্ধ তখন মোটা মুটি থেমে গেছে। সবাইকে কাজে যোগ দিতে অনুরোধ জানানো হোল । আমি থেকে গেলাম ঢাকাতে । ও চলে গেলো কর্ম স্থানে। কারন যাওয়া প্রয়োজন ছিলো । যাওয়ার একমাস পরেই অস্থির হয়ে গেলো আমার বর আমাদের নিয়ে যাবার জন্য। আমাকে চিঠি লিখে আম্মা আব্বাকে চিঠি লিখে ,” ওদের পাঠিয়ে দিন। আমার ছোট মেয়েটার জন্য আমার প্রান কাঁদে’ । আব্বা আম্মা চিন্তায় পরে গেলেন এতো ছোট বাচ্চা নিয়ে আমাকে কি করে পাঠাবে । আমার মেয়ের তিন মাস হয়ে গেলে মেয়ের বাবার অস্থিরতায় আমিও অস্থির হয়ে গেলাম। অবশেষে আমার তিন মাসের মেয়েকে নিয়ে রওয়ানা হলাম বসরাতে মেয়ের বাবার কাছে।
আমরা সাতিল আরবের ওপারেই থেকে গেলাম। ইউভারসিটি কোয়াটারে ফিরে গেলাম না। ওপারেই মানিয়ে নিলান ভালো করে। পুরানো বন্ধুদের সাথে আবারো দেখা। আমাদের পুরনো বন্ধুদের সাথে যোগ হয়েছে আরেকটি দম্পত্তি। আমাদের দেশে যাবার আগের বন্ধু আইভি মাসুদ ভাই, শায়লা ভাবী দের সাথে যোগ হোলো মিতুল আর শামস ভাই। উনারা বড় একটি বাসা ভাড়া করে তিন পরিবার এক সাথেই থাকতেন যৌথ পরিবারের মতো । তারা খুব মিলে মিশে থাকতেন। ইরাকে অনেকেই একটু বড় বাসা নিয়ে দুই পরিবার একসাথে থাকতেন। কারণটা জানি না । হয়তো কিছুটা টাকা বাঁচানো বা কিছুটা নিরাপত্তার জন্য। সেখানে তো ৯১১ ছিলো না কোন বিপদে ছুটে আসার মতো । তাই হয়তো নিরাপত্তার কথাটাও ভাবতেন।তবে এই ব্যাপারটা আমি খুব উপভোগ করতাম। ওরা মাঝে মাঝে দল বেঁধে চলে আসতো আমাদের বাসায়। আমিও আমার মেয়ে তিন্নি কে স্টলারে বসিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম ওদের বাড়ীতে আড্ডা দিতে। সারাদিন চলতো গল্প আড্ডা হাসা হাসির গল্প। আমাদের মনে হতো আমরা যেনো কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী । আমার স্বামী ফেরার পথে আমাদের মা মেয়েকে উঠিয়ে নিতো।

নদীর ওপারের আরো বেশ কিছু পরিবারের সাথে আমাদের জানা শোনা আন্তরিকতা হোল । তখন বসরাটাকে ততো জঘন্য লাগছিলো না। আমার মেয়ে যখন আর একটু বড় হোলো , বড় মানে পাঁচ ছয় মাস বয়েস তখন সকালের দিকে মেয়েকে ষ্টোলারে বসিয়ে হাঁটতে বের হতাম । অল্প এগুলে ছিলো বাচ্চাদের ছোটো ছোটো দোকান , সেখানে বাচ্চাদের নানা ধরণের কাপড় , জুতো , সুন্দর সুন্দর খেলনা পাওয়া যেতো । সে দোকান গুলো ছিলো পারিবারিক মালিকানাতে । পরিবারের লোকজনই দোকানে বসতো । আমি মাঝে মাঝে ওদের কাছ থেকে এটা সেটা কিনতাম ।আমি ওদের ওখানে গেলে ওরা আমার মেয়েকে কাছে এসে হ্যালো বলতো । ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে আমার সাথে গল্প করতো । আগেও বলেছি ইরাকের লোকজন অনেক ভালো ছিলো । আমার মেয়েটাকে বলতো নাম্বার ওয়ান বেবী। আর মেয়েটা ওদের দেখলে মূখ ভরে একটা হাসি দিতো । ওর হাসি দেখে ওরাও হাসতে থাকতো । সময় বয়ে চলে স্রোতের মতো । তাকে ধরে রাখার ক্ষমতা কারো নেই , আমার হাসি ভরা মুখের পাঁচ মাসের মেয়েটা এখন ঈশ্বরের কৃপায় টরোন্টর একজন প্রতিষ্ঠিত আইন জীবী ।

কয়েক মাস পেরিয়ে গেলো । আমার স্বামীর চাকুরির প্রথম চুক্তি শেষ । এখন আবার নতুন চুক্তি গ্রহন করার সময় কিন্তু আমার আর আমার স্বামীর বিন্দু মাত্র ইচ্ছে ছিলো না এদেশে আর থাকার। এবার আমরা দেশে গিয়ে সবাইকে নিয়ে আনন্দের সময় কাটাবো । কাজেই আমার স্বামী নতুন চুক্তি গ্রহন করলেন না। আমরা আমাদের জিনিষ পত্র গুছিয়ে, গাড়িটা বাড়ীর সামনে রেখে, কারন গাড়ী বিক্রি করার লোক সেখানে ছিলো না। আমরা ইরাকের বন্ধুদের মন খারাপ করিয়ে আমরাও বন্ধুদের জন্য মন খারাপ করে বের হয়ে আসলাম ইরাক থেকে। আমরা কুয়েত হয়ে বাংলাদেশে যাবো ।

তখন কুয়েতে আমাদের ইরাকের ঘনিষ্ট বন্ধু রাজ্জাক ভাই ভাবী কুয়েতে। উনাদের অনুরোধে আমাদের কিছুদিন উনাদের ওখানে থাকতে হোলো , তখন আমার মেয়ের বয়েস মাত্র ১০ মাস। আমার মেয়েকে নিয়ে বসরাতে আমরা মাত্র ৬ / ৭ মাস ছিলাম।

ম্যাল্টন, টরন্টো

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles