7 C
Toronto
শনিবার, মার্চ ১৫, ২০২৫

গল্পে ও গানে রবীন্দ্রনাথ

গল্পে ও গানে রবীন্দ্রনাথ

আজকাল বিনা কারনেই মনটা বিষণ্ণ হয়।

- Advertisement -

অহেতুক নানা ভাবনা মনে এসে ভিড় করে। মনে হয় এইতো সেদিন পৃথিবীতে এলাম এতো তাড়াতাড়ি কেনো মনে হচ্ছে যাবার সময় হয়তো এসে যাচ্ছে। জীবনটা বড় বেশি ছোট , তাহলে কিসের এতো আনন্দ, এতো উৎসব , এতো কোলাহল , এতো আয়োজন ,এতো প্রতিযোগিতা , মানুষে মানুষে এতো দন্ধ ? এসব ভাবতে গেলে একটা কষ্ট , একটা ভয় তিরতির করে সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে ।

মাঝে রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায় বলি “ এই করেছো ভালো নিঠুর হে, নিঠুর হে, এই করেছো ভালো” ।

বসন্ত এসে গেছে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে । আমাদের শীতের দেশ কানাডাতেও বসন্ত এসেছে । এতো অস্থিরতার মাঝেও আমার মনে আজ রঙ লেগেছে। কারন আজ যে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪ তম জন্ম বার্ষিকী । কথাটা মনে হতেই মনটা কেমন যেনো রিন রিন করে বেজে উঠলো । গুন গুন করে গেয়ে উঠলাম “ আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে দোলাও ,কে আমারে কি যে বলে ভোলাও ভোলাও” । গানটা গুনগুন করে এগিয়ে আসতেই দেখলাম কি করে যেন “ আজ দখিন দুয়ার খোলা “। খোলা দুয়ারে উঁকি দিতেই দেখলাম , টিউলিপ আর ড্যাফোডিল ফুল গুলো যেনো জেনে গেছে বসন্তের বার্তা । তাই মাটি ফুড়ে নানা রঙের ফুল গুলো নিয়ে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে । বাতাসের মৃদু হাওয়ায় ওরা যেনো গেয়ে চলেছে” ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান “। আর আমি আমার আঙিনার ফুটন্ত ড্যাফোডিল আর টিউলিপের দিকে তাকিয়ে আবারো গুনগুণ করলাম “ ফুলে ফুলে ঢোলে ঢোলে বহে কিবা মৃদু বায়। আহা আজ আমার রঙ লাগা মনটা নানা রঙে রঙিন হয়ে উঠলো কবি গুরুর গানে।

আজ যেনা কতো কতো কিছু মনে পরছে, । কোন এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে মনে করে মাঝে মাঝেই বলি “ তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম” । সত্যিই কি তাকে রাখতে পেরেছি হৃদয়ের মাঝে । যে যায় সে চলেই যায় । তাকে ফিরিয়ে আনা যায় না । তারপরও অভিমান যখন জেগে উঠে বুকের ভেতরে তখন বলি “ নাই যদি বা এলে তুমি এড়িয়ে যাবে তাই বলে? অন্তরেতে নাই কি তুমি, সামনে আমার নাই বলে”।

ইচ্ছে ছিলো জীবনের একটি বিশেষ ক্ষণে গাইবো “ আমার পরানও যাহা চায় তুমি তাই তুমি তাই গো” । যদিও গানটা গাইবার সুযোগ আমার হয়নি। এসব ভাবতে ভাবতে দেখলাম বসন্তের হাওয়া মৃদু থেকে প্রবল হয়ে গেলো । আকাশে কাল মেঘ জমেছে । হঠাৎ করে শুরু হয়ে গেলো ঝূম ঝূম বৃষ্টি । বসন্ত পরিণত হোলো “ আজি ঝড়ো ঝড়ো মুখোরও বাদল দিনে “।

আমার মার মুখে গুন গুন করে গান গাওয়া শুনতাম। আমার মা যুবতী বয়েসে অর্থাৎ ২৯ বছর বয়েসে খুব দ্রুত গতিতে ৬ সন্তানের জননী হয়ে গেলেন। তাই বলে আমার মা কিন্তু খেই হারিয়ে ফেললেন না। ঘুম থেকে উঠে এই ৬ সন্তানের জননী হাত খোঁপা করতেন। খোঁপাতে রুপোর কাঁটা গুজতেন। পাট পাট কুচি দিয়ে শাড়ি পড়ে মুখে হাসি নিয়ে সংসারের কাজে নেমে পরতেন। আমার ধারনা মা নিশ্চয়ই “ ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু “ গানটা দিয়ে সংসারের কাজ শুরু করতেন। কতদিন দেখেছি মা গাইছেন, “ চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে উছলে পরে আলো” গাইতে গাইতে বিছানার চাঁদর গুছাচ্ছেন, ঘরের টুক টাক কাজ করে যাচ্ছেন । আবার কখনো গাইতেন, “ আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে”। মা কার গান গাইছেন সে ধারনা আমার ছিল না। শুধু দেখেছি কাজের ফাঁকে ফাঁকে মায়ের গান গাওয়া ।

একটু বড় হওয়ার পর মা বলেছিলেন এগুলো কবি গুরুর গান। মায়েদের আমলে গানের শিক্ষক রেখে মেয়েদের গান শিখাবার কথা কেউ চিন্তাও করেন নি। মায়ের কাছে শুনেছি মায়ের কোন এক মামাতো ভাই মাকে গান শিখিয়েছিলেন মুখে মুখে।
আমি যখন কিশোর বয়েস পেরিয়ে তরুন বয়েসে পা রাখলাম তখন আমি বুঝতে পারলাম আমার প্রানেও রবীন্দ্র নাথ ঢুকে গেছেন।

মা ৫ বছর আগে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে ৮২ বছর বয়েসে । মা যথেষ্ট বছর জীবিত ছিলেন। কিন্তু আমার মায়ের ইচ্ছা ছিলো হয়তো আরো কিছু দিন আমাদের সাথে থাকার। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো মা ৯০ বছর বেঁচে থাকুক। কতো মা তো ৯০ বছর বেঁচে থাকে আমার মা কেনো থাকলো না এ দুঃখ আমার আজো ।

বাইরে অপেক্ষা করছে মায়ের খাটিয়া ঊঠাবার গাড়ী । মাকে যখন বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গাড়ীতে উঠিয়ে যাত্রা শুরু হোলো মায়ের শেষ ঠিকানাতে । তখন দোয়া দুরুদ পড়ার সাথে সাথে আমার মনে পরছিলো কবি গুরুর কবিতা,
“ দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি বেলা দ্বিপ্রহর যেতে নাহি দিবো । তবু যেতে দিতে হয়
তবু চলে যায় “

কবি গুরু আমার সুখ দুঃখ সব কিছুতে এসে দাঁড়িয়েছেন আমার পাশে ।
জীবনে কতো রকম বিপদে পরতে হয়েছে নানা কারনে। তখনো আমি কবি গুরুর কাছেই ফিরে গিয়েছি , “ বলেছি কবি গুরুর মতো “ বিপদে মোরে রক্ষা করো , এ নহে মোর প্রার্থনা বিপদে আমি না যেনো করি ভয়”। কবি গুরু ছিলেন আছেন আমার ভালোবাসায় , ভালোবাসার অর্থ খুজে যখন বেড়িয়েছি তখন গেয়েছি।“ভালবেসে যদি সুখ নাহি, তবে কেন এ মিছে ভালোবাসা”। আমার বিরহে আনন্দেও কবি গুরুকে পেয়েছি নানা ভাবে। তিনি এসেছেন আমার কাছে একেক রুপে, কখনো জীবনে , কখনো প্রকৃতিতে ।

জানি না আমরা কে কতো দিন আছি এই পৃথিবীতে । জীবন যখন ফুরায়ে যাবে তখন তো আমাদের যেতেই হবে। তবুও বলি “ কহো কানে কানে শুনাও প্রানে প্রানে মঙ্গল বারতা”। কবি তুমি এতো বড় একজন মানুষ হয়েও কি থাকতে পেরেছো । তুমি আছো তোমার সৃষ্টি নিয়ে আমাদের মাঝে। আমাদের চলার পথে। মৃত্যু যখন আমার দ্বারে এসে কড়া নাড়বে, আমি যেনো তোমার মতো করে বলতে পারি
“, অন্তর মম বিকশিত করো অন্তর রহে নির্মল করো , উজ্জ্বল করো সুন্দর করো হে, জাগ্রত করো উদ্যত করো নির্ভয় করো হে’”

ম্যাল্টন, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles