বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সঙ্গীতজ্ঞ কলিম শারাফীর কন্যা আলিয়া শারাফী বাবার এক বিশাল শত জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান আয়োজন করে ছিলেন। ২৫মে ঢাকা ক্লাবে সিনহা লাউঞ্জে এবার আয়োজন করলেন যে সব শিল্পী সেদিন গান করেছেন তাদের ও প্রেস কে ডাকলেন। বলতে চাইলেন গত একটি বছর এই শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানটি কত কষ্টে বিদেশে থেকে তিলে তিলে সাজিয়েছেন। প্রধান কিছু সংবাদপ্রত্র ও টিভি চ্যানেলেদের করেছেন আমন্ত্রণ। ঘন্টা খানেক বলাবলির পর দারুণ বুফে লাঞ্চের ব্যবস্থাও করে ছিলেন। আমি এবার থাকছি উত্তরায়। গত রাতেই বিবি রাশেল ফোন করে বল্লেন তার গুলশান বাসায় চলে আসতে,সেখান থেকে এক সাথে ঢাকা ক্লাবে আলিয়ার অনুষ্ঠানে যাবো। তাই করলাম। নিজ হাতে দারুণ কফি বানিয়ে খাওয়ালেন সকাল-সকাল। বিবির গাড়িতে পৌঁছালাম ঢাকা ক্লাব। আলিয়া শারাফী ওরফে নীলা ভাবীর সাথে আমার সেই তিন কিংবা চার দশকের জানাশোনা।
আমার ছোট ভাই বাড়ি করেছে গোল পাহাড়ের মোড়ে আর নীলা ভাবীরা যে লাল ইটের চার তলা বিল্ডিং এ থাকতেন সেটি চার কদম হাঁটলেই মেহদীবাগে। নীলা ভাবীর কাছে আমি এখনো সেই আশি দশকের আউলা বাউলাই রয়ে গিয়েছি। এই প্রেস আর টিভি চ্যানেলের কী পার্শনদের নম্বর খুঁজে দিলাম ওনাকে। তিনি ফোন করে আসার আমন্ত্রণ জানালেন সবাইকে। এরপর আমি আবার ফোন করে তাদের আসতে বলেছি।
নীলা ভাবীতো থাকেন না এখানে। চেনেন ও না কাউকে। চেনেন মাহফুজ আনাম কিংবা মতিউর রহমানকে,তারা এখনতো আর সাংবাদিক নেই,ডাইনোসর হয়ে গেছেন। আর পত্রিকা কিংবা টিভি চ্যানেলের সংবাদিকগণ আজকাল ডাকলে সহজে আসেন না!গাড়ি পাঠাতে চাইলেও নানা ওজুহাত দেখিয়ে না করে দেন। নতুন পদ্ধতি হয়েছে তাদের কে অনুষ্ঠানে আনার। সেটি এখন নাই বল্লাম! ভালো লাগলো যাদেই বলেছি আমি সবাই পদ্ধতি ছাড়াই এসেছিলেন। এনটিভির রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান আমাকেই বলছেন – আমাদের জহীর স্যার পাঠিয়েন! আমি বল্লাম-জহীরুল আলমের নম্বর আমিই আলিয়া ম্যাডামকে দিয়ে ছিলাম কল করার জন্যে। ভালো লাগে এখনো মিডিয়ার পুরোনো লোকজন ভালোবেসে গুরত্ব দেয় বলে।
বিবি আর আমি সোফায় বসে কথা বলছি। নীলা ভাবী গলা চড়িয়ে এসে বল্লেন – আসার পর থেকে দেখছি বিবির পাশে লেগে আছো! ছাড়ো একটু আমরাও পাশে বসি কথা বলি! আমি বল্লাম – আসার পর না! বিবি ডাকলেন তাই সেই বাসা থেকেই পাশে লেগে আছি। নীলা ভাবীকে আরো রাগাতে দুষ্টুমি করে বিবিকে জড়িয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সমকালের হামিমকে বল্লাম – ভাই ক’টা ছবি তোলেনতো! বিবি শুধু আমার নয় আমার স্ত্রী শাহানা,কন্যা অগ্নিলার ও সমান বন্ধু সেসব নীলা ভাবী জানেন না। নীলা ভাবী মানে আলিয়া শারাফী নিজে একজন ভারতীয় ঘারানার ক্লাসিক্যালের বড় শিল্পী । বারাণসি ঘারনার শাস্ত্রীয় সংগীতের গুরুমা গিরিজা দেবীর শিষ্য। কলিম শারাফীর মত সঙ্গীতজ্ঞ ওনার পিতা। প্রতিভাময়ী মানুষ, এরকম মানুষ সরল মানুষ শিশুর মত হয়। মাঝে মধ্যে ওনাকে রাগাতে আমার ভালো লাগে। নীলা ভাবী রেগে ঠিকই আমাকে বিবির পাশ থেকে টেনে সরিয়ে নিজে পাশে বসে শিশুসুলভ শান্তিতে হাসলেন। ছবি তুলতে বল্লেন। এরকম সরল মানুদের রাগালে পরে ঠিকই খারাপ লাগে।
মিডিয়া ছাড়াও সেই বড় অনুষ্ঠানে গান করা শিল্পীরও এসে ছিলেন। গানের জগতের সবাইকে আমি চিনিনা। তবে এই সময়ের স্বনামধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে বুলবুল ইসলাম উজ্জ্বল নাম। বরণ্য মাযহারুল ইসলামের কন্যা ডালিয়া নাওশীন,স্থপতি কন্ঠশিল্পী লুভা নাহিদ চৌধুরী,বরণ্য নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার আগের বড় অনুষ্ঠানে বলে ছিলেন আবার এখানেও বল্লেন কলিম শারাফীর মত বড় মাপের মানুষ ও বড় জাতের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর জন্যে বাংলাদেশে তেমন বড় মাপের কিছু হয়নি,হওয়াটা উচিত ছিলো। বিবি রাসেল কোনো অনুষ্ঠানে কিছু বলেননা! তবে কলিম শারাফী চাচার অতি প্রিয় বিবি আজ কি করে না বলে পারেন। কী সাবলীল ভাবে সুন্দর বাংলায় কলিম চাচাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলে যা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনলো। স্থপতি,কন্ঠশিল্পী বুদ্ধিজন লুভা নাহিদ চৌধুরী ও কলিম চাচার সেই সময়ের দারুণ স্মৃতিচারণ করলেন। সুপরিচিত তথ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা নিশাত জাহান রানা যিনি দীর্ঘদিন কলিম শারাফী জীবীতকালে তাকে নিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছেন। যেটি ১০ই মে মূল অনুষ্ঠানে দেখানো হয়েছিলো।
রানা বল্লেন তার কলিম শারাফীকে নিয়ে ছবি তৈরীর জার্নীর কথা। কত অসুস্থ অবস্থায়ও ছবির কাজে তার সাথে কতবার কলকাতায় গেছেন। শান্তিনিকেতন যেতে চেয়ছেন। রেগে যাওয়াতে হয়তো সবার শেষে মাত্র এক মিনিট আমাকে বলতে বল্লেন আলিয়া শারাফী ওরফে নীলা ভাবী। আমি আর কি বলবো এক মিনিটে! সঙ্গীতজ্ঞ বলতেই আমার চোখের সামনে আজাদ রহমানের মুখ চলে আসে। জীবনের এক বড় অংশ বিশটি বছর আমি বিয়ের পর থেকে কানাডা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ৬৪/সি গ্রীন রোড আজাদ রহমানের বাড়ি থেকেছি।সঙ্গীতজ্ঞ মানে উল্টেপাল্টে দিনরাত বারবার ওনাকেই দেখেছি। বাংলায় খেয়াল দুই বাংলায় তিনিই প্রথম এলপি বড় রেকর্ড প্রকাশ করে ছিলেন। সেটির কাভার ডিজাইনটি আমি করে ছিলাম। খুব কষ্ট হয়ে ছিলো। ডিজাইনে যাতে বাংলা খেয়ালের মেজাজ ধরতে পারি তাই বিটপী থেকে কাজ শেষে ফিরতে নিচে তার মুভিটোন স্টুডিওর সামনে ধরে ফেলতেন আমাকে। আধঘন্টা বাংলা শুনে তারপর ছাড়তেন। ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় উঠে বাসা ঢুকতে কষ্ট হতো। এক মিনিটে আমি শুধু বল্লাম সেই গানের কথা-এমন একটা মা নয়! এমন একটা মেয়ে দেনা যে বাপের জন্যে সুদূর কানাডায় বসে একটি বছর নানা পরিকল্পনা করে তিন মাস ধরে ঢাকায় থকে জাতীয় পর্যায় এমন একটা স্মরণ অনুষ্ঠান করে নিজের বাবার জন্যে।
*কথাটি বল্লাম এ জন্যে যে আমি রামেন্দু দা ছাড়া ও অনেক নামী দামী পিতা ছিলেন যাদের একটি মাত্র সন্তান এবং কন্যা সন্তান।