9.6 C
Toronto
রবিবার, মার্চ ১৬, ২০২৫

রবি ঊর্ধ্ব গগণে – রবি ভক্তরা ভুবনে

রবি ঊর্ধ্ব গগণে - রবি ভক্তরা ভুবনে
কাঠপুতুল ডেকে কাটমানুষদের বলে দেশে দেশে এত রবীন্দ্র ভক্ত কেন বাড়ে তাঁর গান তো বর্জন করলাম

সূত্র
কাঠপুতুল ডেকে কাটমানুষদের বলে, দেশে দেশে এত রবীন্দ্র ভক্ত কেন বাড়ে? তাঁর গান তো বর্জন করলাম। তাঁকে বললাম হিন্দুর ছেলে। ইংরেজদের দালাল। মুসলিম বিদ্বেষী। মুসলমানদের জন্য মহব্বত থাকলে রমজানের চাঁদ নেই কেন কবিতার অন্তমিলে। সমবেতভাবে তারা বলছে ব্রাদারগণ, পুনরায় আমাদের টার্গেট; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আধুনিক যুগের উল্লাহ-উল্লাহ থিওরি চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। আসুন ফেসবুক, পত্রিকা এবং বক্তৃতায় রবীন্দ্র বিরোধী সুর তুলে ধরি।

সূত্র খণ্ডন ১
‘তবু জেনো অবজ্ঞা করিনি তোমার মাটির দান, আমি সে মাটির কাছে ঋণী- জানিয়েছি বারংবার.. শুনি তাই আজি মানুষ জন্তুর হুহুংকার দিকে দিকে উঠে বাজি। তবু যেন হেসে যাই যেমন হেসেছি বারে বারে পণ্ডিতের মূঢ়তায়, ধনীর দৈন্যের অত্যাচার, সজ্জিতের রূপের বিদ্রূপে’ (জন্মদিন / সেঁজুতি)।

- Advertisement -

সূত্র খণ্ডন ২
শুনুন তাহলে দেশে বিদেশে রবীন্দ্রনাথের ভক্ত দিনেদিনে কেন বাড়ে। যেমন ধরুন কিছুদিন আগে টরেন্টো শহরে রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার খেলা’ এবং ‘রক্তকরবী’ নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেল। তাও পরপর দুই রাতে। এমন একটি কাজ তখনই করা হলো যখন পাকিস্তানপন্থীরা আবারও মাঠে নেমেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মিত্র ও শক্তির উৎসকে আঘাত করতে। রবীন্দ্রনাথের ভক্ত কেন দিন দিন বাড়ে তার একটা উদাহরণ আমাদের এই টরন্টো শহর থেকেই না হয় দেই।

প্রস্তুতি অনেক আগের থেকে। যেমন; আলম পিয়া স্কুলে দীর্ঘদিন ধরে শিশুরা ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ শিখেছে কাহারবা তালে। আরও কারণ হলো; এখনো অরুণা হায়দারের নাচের স্কুলের বাচ্চারা ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে.. তাথা থৈথৈ’ করে নেচে যাচ্ছে। আহমেদ হোসেন ‘শেষের কবিতা’ থেকে শেষ দশ পৃষ্ঠা গড়গড় করে বলে যেতে পারে স্বভাব ভঙ্গিমায়। এই টরেন্টো শহরে ভোরের আলোতে ফারহানা শান্তা কণ্ঠে সুর তুলে গায়, ‘কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।’ আরও কারণ আছে শুনুন। এই শহরে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নাহিদ কবির কাকলি’র একক সঙ্গীত সন্ধ্যা হয়। বলা প্রয়োজন আজও শাহজাহান কামাল, নবীউল হক বাবলু’রা রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালন করে যাচ্ছেন বিরামহীনভাবে। জন্ম থেকে টরেন্টোতে উদীচী, ছায়ানট, বাচনিক, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থার মত প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বকবিকে প্রণতি জানিয়ে আসছে সকলকে সাথে নিয়ে। জিবিনা সঞ্চিতা হককে দেখেছি কাঁধে ‘গীতবিতান’ নিয়ে নিমন্ত্রণ খেতে যায় এ বাড়ি ও বাড়ি। একগোছা বাবরি চুল দুলিয়ে ম্যাক আজাদ ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ নিয়ে আসেন মঞ্চে। আরও শুনতে চান, রবীন্দ্রনাথের নাম শুনলেই ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে চিত্রা সরকার এবং রাখাল দা লং ড্রাইভ করে চলে আসেন টরেন্টোর বাঙালি ডেনফোর্থ এলাকায়।

রাত শেষ হয়ে যাবে। কুপি নিভে যাবে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্তদের নিয়ে কথা বলে শেষ করা যাবে না। আরেকদিন না হয় আকবর হোসেনের কথা কিছু বলবো। তিনি তো বাঘা বাঘা শিল্পীদের ডেকে নিমন্ত্রণ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনান। প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক সাদ কামালিকে জিজ্ঞেস করুন উত্তর-আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তা ও জাতীয়তাবাদ ধারণায় রবীন্দ্রনাথ কোথায় অবস্থান করেন। তিনি আপনাকে অবাক করে দেবেন নানা তথ্য দিয়ে। হাসান মাহমুদ, ফারহানা আজিম শিউলী, ইকবাল করিম হাসনু, কথা সাহিত্যিক ফরিদা রহমান, কথাশিল্পী সালমা বাণী এদের কাউকে জিজ্ঞেস করলে বুঝিয়ে দেবে এখনও কেন রবীন্দ্রনাথ বাঙালির শক্তির উৎস হয়ে বসে আছেন। রাশিদা মুনিরের আবৃতি শুনেন নি। তাহলে শুনে আসুন, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ’। শেখর গোমেজের বুক দেখেছেন? পাঁজরে পাঁজরে তার ‘গীতাঞ্জলী’ বাঁধা। মেরী রাশেদীন, সুমী রহমান, মেহরাব রহমান, সুমন মালিক এরা তো রবীন্দ্রনাথের এক একটি সৈনিক। দেখেননি কানাডায় জন্ম নেওয়া এগারো বছরের মেয়ে অরণী নাটকে রতনের ভূমিকায় অভিনয় করে কি চমৎকার বলেছিল, ‘দাদাবাবু, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে কিছু দিতে হবে না; তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমার জন্যে কাউকে কিছু ভাবতে হবে না।’ নিয়মিত নামাজ পড়া কাজী হেলাল তিনিও ধুতি পরা বেশভূষায় ‘পোস্টমাস্টার’ সেজে করতালিতে মুখরিত হয়েছিলেন।

ঋতু মীর তো মাষ্টার। যদি জানতে চান রবীন্দ্রনাথ এই নামটির পেছনে – ‘নাথ’ কেন বসেছে, সেটিও তিনি সূরে সূরে বুঝিয়ে দেবেন। রবীন্দ্রনাথ কবে কোথায় ভ্রমণ করেছেন? জিজ্ঞেস করুন সুব্রত কুমার দাসকে। দিনক্ষণ গুণে গুণে বলে দেবেন তিনি। বিশ্বকবির বিদেশী বন্ধুর তালিকা, এমন একটি প্রবন্ধ এক খোঁচাতে যিনি লিখে দিতে পারেন তিনি হলেন সুজিত কুসুম পাল। নাম তো অনেক ভুলে গেছি। অথবা রবি ভক্ত সকলের সাথে যোগাযোগ নেই তেমন। এ আমার দীনতা বা দুর্ভাগ্য। বিশেষ করে পশ্চিমবাংলা থেকে এসে যারা বসতি গড়েছেন টরন্টো শহরে তাদের সাথে নেই তেমন সখ্যতা। সেরীন ফেরদৌস তো একটা বইয়ের পোকা। রবীন্দ্রনাথের চিঠি সংক্রান্ত কোন তথ্য চেয়ে দেখেন, ক্ষিপ্রবেগে বলে দেবে, হতাশ করবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন কাব্য কোন পরিবেশে বসে লিখেছিলেন সেসব জানার সূত্র হলো কবি দেলওয়ার এলাহী। ড. মোজাম্মেল খান জানেন কবি ইয়েটস, মহাত্মা গান্ধী কিংবা আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো বিখ্যাত লোকেরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কী কী বলেছেন। সংবাদ এনসাইক্লোপিডিয়া নজরুল ইসলাম মিন্টো বুকে চেপে রাখেন অনেক তথ্য এবং রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কথা হলে তর্জনী তুলে উচ্চারণ করেন, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। ভুলেও যেন রেজা অনিরুদ্ধের সামনে না পড়েন। রবীন্দ্রনাথের লেখায় দাড়ি কমা কোথায় বসবে তাও ঠিক করে দেবে সে। বাংলার গদ্যরীতিতে রবীন্দ্রনাথ কী পরিবর্তন এনেছেন জানতে হলে সাংবাদিক শওগাত আলী সাগরকে নক করুন, রবীন্দ্র রচনাবলী থেকে এমন পাঠ দেবে যা আপনি কখনো ভুলতে পারবেন না।

কথা হলো আজ কারোর নাম নিতে আসিনি। শুধু বলতে এসেছি ফুঁসে ওঠার মতো অগ্নি লাভা আছে এই টরন্টো শহরে। এক সাথে তারা চেঁচিয়ে উঠলে বাংলা ভূমিকম্পে কেঁপে উঠবে শহর। এই টরেন্টো শহরে দশ বিশজন রবীন্দ্র গবেষক পেয়ে গেলে অবাক হবেন না যেন। আপনাদের প্রতিটি অপবাদ বাক্য খণ্ডন করে দেবার সক্ষমতা রাখেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের সমাজ ভাবনা নিয়ে জিজ্ঞেস করুন ভজন সরকারকে, দেখবেন বিশ পাতার ফর্দ লিখে আপনার ইনবক্সে পাঠিয়ে দেবেন। কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল থাকেন এখানে, তাঁর কাছে গিয়ে বসুন। তিনি রবীন্দ্রনাথ আর বঙ্গবন্ধুর মাঝে জোড়াসাঁকো গড়ে দেবেন বিনা ইট পাথরে। যারা এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন তাদের কথা না হয় আর একদিন বলবো। যাদের নাম এখানেও বলা হলো না। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান, প্রচেষ্টা, উদ্যোগ, আয়োজন, এবং রবীন্দ্র ভক্তরা রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করেছেন প্রাণের ভালোবাসা দিয়ে তাদের সকলের কথা বলা গেল না সেজন্য দুঃখিত। কিন্তু কিছুটা তো আন্দাজ করতে পেরেছেন রবীন্দ্রনাথের ভক্ত কেন দিন দিন বাড়ে।

এইতো গেল কানাডার টরেন্টো শহরের কথা। পৃথিবীর বুকে এমন শতশত টরেন্টো আছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে ঘরে ঘরে রবীন্দ্রনাথ বসত করেন। তাঁর নাম উচ্চারিত হয় পিতা পুত্র, মাতা কন্যার কণ্ঠনালীতে। যারা শুধু বিরোধিতা করার জন্য বিরোধিতা করেন। রবীন্দ্রনাথের কপালে লাল ক্রস চিহ্ন দিয়ে অপেক্ষা করেন কতটুকু ক্ষতি করতে পারলেন। তাদের বলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো অনেক আগেই দেহ ত্যাগ করেছেন। তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে এতসব ষড়যন্ত্র কীভাবে উবে যায়, একবার চিন্তা করে দেখেন। হয়তো জীবিত রবীন্দ্রনাথ হতে মৃত রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি শক্তিশালী। তিনি আছেন কাগজে কলমে, তিনি ঠাই নিয়েছেন হৃদয় মননে। তিনি মায়া, তিনি প্রেম এবং তিনি আছেন গ্রহণযোগ্যতার আসনে। তাঁর সুন্দর সুন্দর সৃষ্টির প্রাণ হলো – সত্য।

রবিকে আড়াল করতে হলে আম পাতা জাম পাতা দিয়ে আড়াল করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন একটি বড় গ্রহ। যা সূর্যের চেয়ে বড়। আমাদের আপত্তি নেই রবির মতো আরও একটি গ্রহের সাথে মিতালি করতে। আদতে আমরাও চাই বাংলার আকাশে জেগে উঠুক হাজারো রবি। এমন কেউ এসে হাজির হলে হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশাপাশি তাঁর আলোতেও দুলবে গোটা জাতি। সমস্যা হলো রবির আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারেন এমন অনেকেই এসেছিলেন কিন্তু রবি অতিক্রমটা তাঁরা করতে পারেননি। তাঁদের কেউ কবি হিসেবে খ্যাতির চূড়ান্তে। কেউ হয়তো সুরকার, গীতিকার, ছোট গল্প লেখক, নাট্যকার, উপন্যাসিক কিংবা দার্শনিক। হয়তো তাঁদের কেউ অভিনয় বিশারদ কিংবা চিত্রশিল্পী। কেউবা সমাজ সংস্কারক, বাংলা সাহিত্যের বিশেষ কর্ণধার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বিশ্ব সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছেন। অন্যরা যেমন এক একটি ক্ষেত্র কিংবা বিশেষ দু’একটি ক্ষেত্রে উচ্চতার শিখরে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে রবীন্দ্রনাথ একইসাথে একাধিক। রবীন্দ্রনাথ কোন টাওয়ার বা মিনার নয়। তিনি পাহাড়। পাহাড় যেমন সমতার রেখা নয়, একাধিক উচ্চতার খাঁজ নিয়ে আকাশচুম্বী হয়। রবীন্দ্র সৃষ্টিও তেমনি। তিনি প্রেম ভালোবাসা এবং মানবিকতার কথক। তিনি একটি রাবীন্দ্রিক ভাবধারা সৃষ্টি করেছেন। আপনার আনন্দ যেখানে তাঁর গড়া পর্বতের সেই খাঁজে গিয়ে বসে থাকতে পারবেন অনায়াসে। রবীন্দ্রনাথ কোন কিছু পরিবর্তন করতে আসেননি। তবুও তার ছোঁয়ায় পরিবর্তন এসেছে অনেক ধারার। তিনি অশেষ অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি অনুসৃত। কাজেই তাঁর কাছ থেকে আপনার আমার নেবার সুযোগ অপার। রবীন্দ্রনাথ যত দিয়েছেন তার থেকেও অনেক বেশি দিয়ে যাক অন্য কেউ এসে, এতে তো কোন বাঁধা নেই। বাংলার আকাশে আরও রবি উদিত হবে এ আমাদের প্রত্যাশা। তবে একই সাথে এও আশা করবো অচিরেই যেন মুছে যায় বিশ্বকবির বিরুদ্ধে কাঠপুতুল এবং কাটমানুষদের অন্তরের গ্লানি।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles