14.2 C
Toronto
রবিবার, মার্চ ১৬, ২০২৫

নির্মোহ নেত্রপাত

নির্মোহ নেত্রপাত
পঙক্তি কটি কি পরিমাণে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে এবারে তা বিচার করে দেখা যাক

কবি নির্মলেন্দু গুণকে শ্রদ্ধা জানাতে আমার এই লেখা। ‘হুলিয়া’ কবিতার মুক্ত আলোচনায় চারজন তরুণ অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমার শিক্ষক খোন্দকার আশরাফ হোসেন তরুণদের অন্তর্দিগন্ত প্রসারণে সতত সচেষ্ট ছিলেন। মুক্ত আলোচনার ভূমিকায় তাঁর ভাষ্য ছিল আন্তরিক ও যৌক্তিক : ”এই প্রজন্মের চোখ পর্যায়ে তরুণ কাব্যরসিক ও বোদ্ধাদের নির্মোহ ও নিরঞ্জন নেত্রপাত ঘটবে আমাদের খ্যাতিমান কবিদের জনপ্রিয় কবিতাবলীর উপর। এ কথা স্বীকার্য যে কেবলমাত্র মুক্ত আলোচনার ভিত্তিতেই নতুনরা পুরাতনকে গ্রহণ বর্জন অধিগ্রহণ বা স্বাঙ্গীকরণ করতে স্বীকৃত হতে পারে। কোন মোহন কিম্বদন্তীর করদমিত্রতা কাম্য নয় তাদের। দু’ আঙুলের টোকায় বাজিয়ে নিতে হবে ভালোবাসার টাকা, কেননা একমাত্র খাঁটিত্বের অভিজ্ঞানই হতে পারে ভালোবাসার ভিত্তিমূল।”

নির্মলেন্দু গুণের “হুলিয়া”: নির্মোহ নেত্রপাত

- Advertisement -

প্রায়-মধ্যযুগীয় এবং ঘৃণ্য স্বৈরশাসনের নাগ-বলয় থেকে পরিত্রাণ প্রয়াসে ঊনসত্তরের যে অনিবার্য গণ-অভ্যুত্থান ঐতিহাসিক অধ্যায় সৃষ্টি করে তার কিছুকাল পূর্বে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পটভূমিকায় বিরচিত হয় নির্মলেন্দু গুণের “হুলিয়া” কবিতাটি। “প্রেমাংশুর রক্ত চাই” (১৯৭০) কাব্যের অন্তর্ভুক্ত এই কবিতার শিরোনামদৃষ্টে অনায়াসে অনুমিত হয় যে, কবিতার নায়ক মুক্তিকামী বা স্বাধিকারবাদী একজন বিপ্লবী কন্ঠস্বর। ফলত কবিতার নায়ক কি পরিমাণে বৈপ্লবিক চেতনা ধারণ করতে পেরেছেন তা যেমন হবে আমাদের আলোচ্য বিষয় তেমনি আমরা কবিতার আঙ্গিক, মৌল প্রকরণ, অর্থপ্রতীতি ও বিভূতিবিষয়ক দিকগতুলোতেও যাতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে পারি তদ্বিষয়ে সচেষ্ট থাকবো।

নির্মোহ নেত্রপাত

শুরু থেকেই কবিতাটিতে প্রমূর্ত হয়েছে পরিবর্তনের একটি পরিব্যাপ্তি। তবে পরিবর্তনটি মৌলিক নয়। গ্রামের ‘কালোমাটির আল’ কিংবা ‘ভাঙাপথ’-এর কোন মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়নি। পরিবর্তন প্রতিভাত হয়েছে নায়কের বাসগৃহে এবং তাঁর নিজস্ব অবয়বে। প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের শ্যেনদৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে পাঁচ বছর পর “চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে” নায়ক স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছেন–পরিচিত রাজনৈতিক নেতা, রফিজ–সকলেই তাঁর রূপান্তর উদ্ঘাটনে হচ্ছে ব্যর্থ। বাসগৃহের পরিমণ্ডলে সূচিত হয়েছে একটি আরণ্যক অনুশাসন। এভাবে, কায়িক কিংবা প্র্রাকৃতিক পরিবর্তন বিপ্লবের ইঙ্গিতবহতাকেই স্পষ্টতা দান করছে। কবির বৈপ্লবিক চেতনা যেখানে তুঙ্গে আরোহন করেছে আমরা সেই পংক্তি কটি এবার উদ্ধৃত করবো :

আমি ঘরের ভিতরে তাকালুম, দেখলুম
দু’ঘরের মাঝামাঝি যেখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি ছিল
সেখানে লেনিন, বাবার জমা-খরচের পাশে কার্ল মার্কস,
আলমিরার একটি ভাঙা কাচের অভাব পূরণ করছে
স্ক্রুপস্কায়ার ছেঁড়া ছবি।

পঙক্তি কটি কি পরিমাণে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে এবারে তা বিচার করে দেখা যাক। দেব-দেবীর নিত্য পূজার্চনায় প্রধানত হিন্দু গৃহবধূরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। সুতরাং আমরা কি ধরে নিতে পারি না যে, নায়ক-মাতার রক্ষিত সিদ্ধিদাতা গণেশের স্থলে লেনিনের চিত্রের সংস্থাপিকা স্বয়ং নায়ক-মাতা? “বাবার জমা-খরচের পাশে” কার্ল মার্কসের চিত্রটির সংস্থাপক সম্ভবত নায়কের পিতা। এই প্রত্যন্ত পল্লীগৃহে নাদিয়েজদা স্ক্রুপস্কায়ার ছুবিও দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠেনি! কবিতাটিতে আকস্মিকভাবে চিত্রগুলো সন্নিবেশ করে কবি আদৌ অকৃত্রিমতার পরিচয় দিতে পেরেছেন কি না তা আমাদেরকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। সম্ভবত একটি সঙ্গত বাতাবরণ অন্বেষণের আগেই কবি চিত্র প্রতিষ্ঠার আবাহনাত্মক কর্মটি নিষ্পন্ন করেছেন। পূজাবেদিতে লেনিনের অভিষেক একটি বিপ্লবাত্মক ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি করলেও ‘স্ক্রুপকাযার ছেঁড়া ছবি’-টি তুচ্ছার্থে তথা “আলমিরার একটি ভাঙা কাচের অভাব পূরণ” নিমিত্ত ব্যবহৃত হওয়ায় পঙক্তিটির সামগ্রিক তাৎপর্য সামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা বিপ্লবাত্মক হয়ে উঠতে পারেনি। চিত্রগুলোর সামগ্রিক বিন্যাস যেমন অবিপ্লবাত্মক তেমনি মা-বাবা চরিত্রদ্বয় অরাজনৈতিক। কেননা, কবিতাটিতে মা এবং বাবা চরিত্রদ্বয় যেভাবে চিত্রিত হয়েছে সেই বিচারে মা-বাবার মানসিকতায় আমরা কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক বিপ্লবের দীপ্তি অন্বেষণ করতে পারি না। কবিতায় আমরা মার অশ্রু-বিপ্লুত ভারতীয় বাৎসল্য এবং বাবার দারিদ্র্যজনিত অব্যক্ত রোদনই শুধু প্রত্যক্ষ করি। আমাদেরকে ধরে নিতে হয় যে, অপত্য স্নেহের আধিক্য হেতু হয়তো মা-বাবা সন্তানের প্রিয় চিত্রগুলো গৃহে সংস্থাপন করেছেন। এভাবে বিচার করলে দেখা যায় যে, পঙক্তিগুলোতে যে বিপ্লবটি সংঘটিত হয়েছে তা নিতান্তই “স্নেহের বিপ্লব” যা কবিতার আনুপূর্বিক বিপ্লবাত্মক গতির সঙ্গে অসমান্তরাল।

উদ্ধৃত পঙক্তিগুলো নিহিতার্থগত দিক থেকে অপ্রমেয় নয়। স্বয়ং কবিতার নায়কই হচ্ছেন চিত্রগুলোর সংস্থাপক। এবং চিত্রগুলো সংস্থাপিত হয়েছে নায়কের চৈতন্যগত তথা সত্তাগত বৈপ্লবিক পটে। এ স্থলে নায়ক অবতীর্ণ হয়েছেন একজন প্রত্যয়ী বিপ্লবীর অনিরুদ্ধ ভূমিকায়। এই বিশ্লেষণকে গ্রহণ করলেও আমরা অন্বিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে পারি না। কবিতার শেষে বিপ্লবী বন্ধুবর্গের বিধুর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রশ্নাবলির উত্তরে নায়ক বলেন :

‘আমি এসবের কিছুই জানি না,
আম এসবের কিছুই বুঝি না।’

নায়কের এই উচ্চারণে তাঁর বৈপ্লবিক anticipation এর সম্ভাবিত স্বরূপকে আমরা অন্তরিত দেখি। আর এভাবে কবিতার মৌল প্রকরণে প্রকটিত হয় অসঙ্গতির অবভাস। নায়কের ক্ষীণকণ্ঠজাত এই অসহায় উচ্চারণ মূলত উচ্চকিত হয়েছে অনিশ্চয়তার উপান্তে। একজন প্রত্যয়ী বিপ্লবী-সত্তায় তিনি আর অনড় থাকতে পারেননি; স্বপ্রতিষ্ঠ চৈতন্য হতে পারেনি উপলব্ধির সুমিত স্মারক।

‘হুলিয়া’ কবিতার নায়ক পরিপূর্ণ ও একক বিপ্লবী সত্তার ধারক হতে পারেননি। তাঁর চরিত্রে বিধৃত হয়েছে ব্যর্থ প্রেমিক সত্তা; নস্টালজিক অনুভূতির আবর্তে তাঁর আবেগ হয়েছে প্রকম্পিত:
“…আহা সেই বাসন্তী এখন বিহারে
ডাকাত স্বামীর ঘরে চার সন্তানের জননী হয়েছে।”

বিপ্লবী সত্তা ও প্রেমিক সত্তার সাথে প্রযুক্ত হয়ে যে সত্তাটি নায়ক চরিত্রে একটি ত্রিগুণাত্মক প্রবাহ সঞ্চারিত করেছে তা হচ্ছে নায়কের শিশুসত্তা। কবিতার একটি উল্লেখযোগ্য অংশে এই শিশুসত্তাটি মাতৃস্নেহের সিক্ত স্পর্শে সিঞ্চিত হয়ে উঠেছে। আলোচনার সুবিধার্থে কবিতাংশটি উদ্ধৃত করছি।

বহুদিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি
চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে
অফুরন্ত হাওয়ার ভিতরে সেই আমি
কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দী হয়ে গেলুম।
সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে
একটি অবুঝ সন্তান হ’য়ে গেলুম।
মা আমাকে ক্রন্দনসিক্ত একটি চুম্বনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে
অনেক জঙ্গলের পথ অতিক্রম ক’রে পুকুরের জলে চাল ধুতে গেলেন।

‘হুলিয়া’ কবিতার সাথে আলমাহমুদের ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতার যে একটি আঙ্গিকগত সাযুজ্য রয়েছে তা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। বিশেষত ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতার শেষ পঙক্তি কটির সাথে ‘হুলিয়া’ কবিতার চরণগুলোর রয়েছে একটি আবেগগত অনুবন্ধ। ‘হুলিয়া’-নায়কের শিশুসত্তা বন্দিত্ব গ্রহণ করেছে মাতৃ-আলিঙ্গনের স্নেহময় উষ্ণতায়। প্রকৃত অর্থে নায়কের এই বন্দিত্ব আর উন্মোচিত হয়নি; আশ্লিষ্ট শিশুসত্তার উদ্বোধন কোনক্রমেই স্পষ্টতর হয়ে ওঠেনি কবিতার শেষাংশে।
‘হুলিয়া’ কবিতার বিভূতি মুখ্যত রাজনৈতিক চেতনা হলেও শব্দের সারল্য, ভাষার প্রাঞ্জলতা, প্রতীকতা এবং চিত্রককল্প আমাদেরকে চমৎকৃত করে। অত্যন্ত সাধারণ এবং সুপরিচিত শব্দ যে কবির হাতে ব্যাঞ্জনাদীপ্ত ও প্রতীকাশ্রিত হতে পারে ‘হুলিয়া’ কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ সে স্বাক্ষর রেখেছেন। নিম্নে একটি দৃষ্টান্ত প্রদত্ত হলো :

‘একটি শেয়াল একটি কুকুরের পাশে শুয়েছিল প্রায়
আমাকে দেখেই পালালো একজন,
একজন গন্ধ শুঁকে নিয়ে আমাকে চিনতে চেষ্টা করলো
যেমন পুলিশসমেত চেকার তেজগাঁয় আমাকে চিনতে
চেষ্টা করেছিল।

শেয়ালকে এ স্থলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অনুচর রূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কুকুরটি ঐতিহ্যগত বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবেই বলয়িত থাকেনি, কবির হাতে কুকুরটি ‘পুলিশ সমেত চেকার’-এর সাথে তুলিত হওয়ায়, একটি ব্যক্তিগত প্রতীকের স্তরে উন্নীত হয়েছে। মিত্রের বিশ্বস্ততার পরিবর্তে মিত্ররূপী দালালের স্বার্থ-সিদ্ধতাই জ্ঞাপিত হয়েছে কুকুরের মাধ্যমে। শুধু স্বৈরাচারী আয়ুব-রাজত্বের প্রেক্ষাপটে কেন, যে কোন পুঁজিবাদী কিংবা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নির্মলেন্দু গুণের এই কবিতাংশটি গুরুত্বপূর্ণ আবেদন সৃষ্টি করতে পারে।

গদ্যছন্দে লিখিত ‘হুলিয়া’ কবিতাটি নাট্যধর্মী এবং বহুলাংশে গতিশীল। ‘যাত্রা’ কবিতাটির একটি আবেদনক্ষম মোটিফ। অনস্বীকার্য যে, আমাদের অধিকাংশ যাত্রা অভীপ্সিত শীর্ষ স্পর্শে অপারঙ্গম। এবং প্রগতিবাদী রাজনীতি সুনিশ্চয়তার চাবিকাঠি সমর্পণে অদ্যাপি যেখানে সামূহিক শক্তি ও সজীবতাকে সঞ্চয় করতে পারেনি এরূপ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে কবিতাটির প্রাসঙ্গিকতা যে ক্ষীয়মান নয়, তা বিলক্ষণ উপলব্ধ হয়। বস্তুত এভাবেই আমরা আবিষ্কার করতে পারি কবিতাটির প্রসিদ্ধির অন্তর্লীন কারণ।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles