
২০০৭ সালের মার্চের ৭ তারিখে নিজের মাতৃভূমিকে বিদায় জানিয়ে বৃটিশ এয়ারওয়েজে করে কানাডার টরন্টোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম। সে সময় বৃটিশ এয়ারওয়েজ যোগে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় আসা যেত।পরে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। হিথ্রো এয়ারপোর্টে হয়েছিল কয়েক ঘন্টার বিরতি। আমি আর আমার হাজব্যান্ড। উনি হিথ্রোর বিশাল কাচের জানালার বাইরে চোখ রেখে হারিয়ে গেছেন দেশের স্মৃতি রমোন্থনে। চোখে জল দিব্যি ছলছল করছে। হয়তো লুকানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছিলেন।
দেশ ছেড়ে মা-মাটি ছেড়ে কাছাকাছি কোনো দেশে গিয়েও থাকবেন এটা ভাবেন নি কখনো। অথচ দেশ ছেড়ে হাজার মাইল দূরত্বে যেতে হচ্ছে তাও আবার স্থায়ী বসবাসের জন্য তা তিনি হয়তো সহজে ভাবতে পারছিলেন না সে দিন।
আমি মনে-প্রাণে শক্ত মানুষ। আবার সহজে কোনো কারণে চোখের জলের অস্তিত্ব লক্ষ্য করি কখনো কখনো। আমার কানাডায় আসার পরিপূর্ণ মতামত ছিল। আমার হাজব্যান্ড আমার পছন্দকে ১০০ ভাগ ভালোবেসে নিজের পছন্দের কথাটা আর ভাবেন নি। তাই তো আজ এদেশের বাসিন্দা।
আমরা যখন টরন্টোর পিয়ারসন এয়ারপোর্টে নামি তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। আমাদের কোনো কাছের আত্মীয় বা তেমন কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব ছিল না সারা কানাডা জুড়ে। এক জন পরিচিত মানুষের পরিচিত এক জনের বাসায় উঠে পরের দিন নিজেদের এপার্টমেন্টে উঠব এমনই কথা ছিল। রাত বেড়েছে। মোটাসোটা ব্লাক এক জন ট্যাক্সিওয়ালা এসে আমাদের গন্তব্য জানতে চাইল। আমরা ঠিকানাটা তার কাছে দিলাম। ছুটে চলছে ট্যাক্সি টরন্টোর রাতের ব্যস্ত নগরীর মধ্যে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে। সে দিন ট্যাক্সির জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখে মনে হয়েছিল এ শহরে কীভাবে নিজেদের দাঁড় করাব! সবই তো লাগছে ভীষণ অচেনা। অনেকটা অসহায়ও ফিল হচ্ছিল।
ট্যাক্সিওয়ালা দ্রুত ছুটছে। আমাদের মতো চিন্তার এপার-ওপার করে তার লাভ নেই। যত তাড়াতাড়ি সে আমাদের নামাতে পারবে আরেকটা ভাড়া জুটাতে পারবে। তখনই কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম এদেশে কতোটা পরিশ্রম করলে পায়ের নিচে মাটি থাকতে পারে। সঙ্গে করে কয়েক হাজার ডলার এনেছিলাম। তাও সংখ্যা হবে পাঁচের নিচে। যদি কোনো চাকরি-বাকরি না জুটে তাহলে ওতোটুকুন টাকা নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে। দেশ থেকে অর্ডার করলেই বস্তা ভরে টাকা পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। আল্লাহর ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল ছিলাম ও আছি আজ অবধি।
কানাডিয়ান লাইফকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে অনেক পরিশ্রম-চেষ্টা করতে হয়েছে। আজ থেকে সতের বছর আগের কথা। তখনোও সব কিছু হাত বাড়ালেই হতো না। বরং অন্টারিওর মিনিমাম ওয়েজ ছিল অনেক কম। চাকরিও হাতের মোয়া ছিল না।
আল্লাহর অশেষ রহমতে ধীরে ধীরে অনেক কিছু অতিক্রম করেছি। দুই জন মিলে ফুল টাইম কাজ করেছি শুরু থেকেই। কানাডিয়ান এডুকেশন নিয়েছি। বর্তমানে দুই জন দুই প্রফেশনে কাজ করছি। বর্তমানে টরন্টোর মতো শহরে বাস করা অনেক ব্যয়বহুল।
শুধুমাত্র আল্লাহর রহমতে ও নিজেদের চেষ্টায় যেভাবে যতটুকু করতে পারা গেছে তাতে এখনো এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যে পরতে হচ্ছে না। নতুনদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তবে সবকিছুই বদলে যায় ধীরে ধীরে। হয়তো আপনাদের চাওয়া-পাওয়াও দ্রুত পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ। চেষ্টা আর ধৈর্য না থাকলে পৃথিবীর কোথাও কিছু করা যায় না।
আল্লাহ আপনাদের সুস্থ রাখুন
টরন্টো, কানাডা।