
‘হালাকা ন্যাশনাল পার্ক’। যেখানে আছে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। এক সময় জীবন্ত ছিলো এই আগ্নেয়গিরি তার প্রমান রয়ে গেছে মাওয়াইয়ের বিভিন্ন জায়গাতে । আমরা সমতল ছেড়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছি । পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে রাস্তা । আঁকাবাঁকা পথ।
আমরা শহর ছেড়ে উঠে গেছি চার হাজার ফুট ওপরে । কখনো আমরা নেমে যাচ্ছি সুড়সুড় করে নিচে, কখনো আবার ধেই ধেই করে উপরে। আমাদের ভাড়া করা ছোট গাড়ীটি হাওয়াইয়ান মেয়েদের মতো কোমর দুলিয়ে শরীর দুলিয়ে নেচে যাচ্ছে । রাস্তার একদিকে পাহাড়, আরেকদিকে চার হাজার ফুট নিচে সমতল ভুমি । ভয়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা । আঁকাবাঁকা পথের জন্য পাঁচ গজ দূর থেকে যে গাড়িটি আসছে তাও দেখা যাচ্ছে না । আমার ভাণ্ডারে ছোট বেলা থেকে বড় বেলা পর্যন্ত দোয়া- দুরুদ আছে এবং শিখেছি সব পড়তে থাকলাম ।
ভাবছিলাম বেঁচে থাকার যেমন সৌন্দয্য আছে , তেমনি মৃত্যুরও একটা সৌন্দয্য আছে। বেড়াতে এসে পাহাড় থেকে পড়ে জ্বলন্ত গাড়িতে পুড়ে আমাদের মৃত্যু হোক সেটা আমার কাম্য না। আমরা উঠতে উঠতে আট হাজার ফিট উপরে উঠে গেছি। এতক্ষণে মেঘেরা আমাদের সাথী হয়েছে। হালকা মেঘ আমাদের গাড়িটাকে ছুয়ে ছুয়ে যাচ্ছে । আমি আপন মনে আমার স্বামীর সাথে কথা বলে যাচ্ছি – ‘এতোই যদি পাহাড়ে উঠার সখ তাহলে হিমালয়ের দিকে গেলেই হতো । বেড়াতে এসে এটা কেমন ধরনের অত্যাচার ? এবার যদি বেঁচে যাই তাহলে তোমার সাথে এটাই আমার শেষ ট্রিপ ।
আমার স্বামী নির্বিকার ভাবে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে । আমার কথা থেকে রক্ষা পাবার জন্য সে সিডিতে ফুল ভলিয়ামে রবীন্দ্র সংগীত বাজিয়ে দিলো ।
আমরা চলে এসেছি দশ হাজার ফুট ওপরে আমাদের কাঙ্ক্ষিত আগ্নিয়গিরির পাশে। গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলতে গিয়ে দেখলাম বাতাসের তেজে দরজা খোলা যাচ্ছে না। মনে হলো একশত মাইল বেগে হাওয়া বইছে। বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম । বাতাসের প্রচণ্ডতায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। মনে হলো বাতাস আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে । বাইরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথার ওপরে রাখা সানগ্লাসটা উড়ে চলে গেলো । দেখলাম কিভাবে আমার সূর্যের আলো থেকে রক্ষাকারী চশমাটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে । ওকে ধরার কোনো চেষ্টা আমি করলাম না, তাহলে আমিও হয়তো একটুকরো কাগজের মতো উড়ে উড়ে আগ্নেয়গিরির ওপরে গিয়ে পড়বো । পাঠকরা হয়তো আমাদের বাতাসের ভীতি দেখে ভাবছেন আমি কোনো শীর্ণ আকারের মানুষ । আসলে সেটা না, আমি মোটামুটি শীর্ণতার বিপরীত দিকে চলমান একজন মানুষ ।
বাতাসের সাথে মোটামুটি যুদ্ধ ঘোষণা করে আমি ও আমার স্বামী একে অপরের কাঁধে ভর করে হেঁটে ওপরের দিকে উঠলাম সবাই সে ভাবেই যাচ্ছিলো । একা হাঁটার কোনো উপায় ছিলো না। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে পুরো আগ্নেয়গিরিটা । সেখানে গ্লাস দিয়ে ঘেরা একটি ঘর বানানো হয়েছে। সেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আগ্নিয়গিরি থেকে সংগ্রহ করা নানাবিধ জিনিস। তাছাড়া অন্যান্য অনেক জিনিসও বিক্রি হচ্ছে। সেখান থেকে আমি কিনে নিলাম আমার চোখ দুটোকে সূর্য ও বাতাস থেকে প্রতিরোধ করার জন্য আরেকটি চশমা । ঘরটির বাইরের চারপাশে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে রেলিং দিয়ে ঘেরা নিরাপত্তার কারনে। রেলিং শক্ত করে ধরে দেখলাম সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। উঁচু উঁচু টিলার ওপর মসৃণ ভাবে লাল আভা জড়িয়ে আছে। আর তার পদদেশে কালো কালো শুকিয়ে যাওয়া আভা। যা জমে জমে বিশাল বিশাল পাথরের মতো হয়ে আছে। বাতাসের গতি বাড়তে লাগলো , যার ফলে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না। কিছু ছবি নিয়ে বাতাসের সাথে আবার সংগ্রাম করে আবার ফিরে এলাম গাড়িতে । ফিরে চলেছি হোটেলে । আবারো আঁকাবাঁকা পথ, আবারো ভয়, সব মিলিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিলাম।
চলে এলো ফিরে যাবার দিন। আমাদের হোটেলে একপাশে চারিদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা সুইমিংপুল । নানা রকম ফুল দিয়ে দিয়ে সজ্জিত সুইমিংপুলের চারপাশটা । পুল এলাকাতে রয়েছে রেস্তোরাঁ । কেউ খাচ্ছে কেউ পান করছে। আমরা প্রতিদিন সেখান থেকে সকালের নাস্তা খেয়ে বের হতাম। সন্ধ্যার পর সেখানে বসতো গানের জলসা। একেকদিন একেক গায়ক এসে গান করতো । তার সাথে চলে তাজা ফুলে সজ্জিত হাওয়াইয়ান কন্যার লঘু নৃত্য । চারিদিকে বাঁশের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। খুব একটা রোমান্টিক দৃশ্য সেটা । দেখে চোখ জুরিয়ে যায় । ফিরে আসার দিন রেস্তরায় কর্মরত ছেলে মেয়েদের কাছে বিদায় নিলাম সকালে নাস্তা খাবার সময়। তারাও আন্তরিক ভাবে বিদায় জানালো । আমন্ত্রন জানালো আবার যেনো বেড়াতে আসি তাদের দ্বীপটিতে । আমরা তাদের নিমন্ত্রমে সম্মতি জানালাম। মাওয়াইয়ের সৌন্দয্যে যেমন মুগ্ধ হয়েছি , সে রকমই মুগ্ধ হয়েছি সেখানকার মানুষদের আন্তরিকতায়। আমাদের ফ্লাইট রাতে দিনটা কাজে লাগাবার জন্য শেষ বারের মতো চারপাশটা ঘুরা ঘুরি করলাম । কিছু কেনা কাটাও আবার করলাম টরোন্টর বন্ধু বান্ধবের জন্য ।
রাতের অন্ধকারে বিমান ছূটে চলেছে টরেন্টোর দিকে। যেখানে আমার বাস । মাওয়াইয়ের স্মৃতি ,সৌন্দয্য পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি । দশ ঘণ্টা উড়তে হবে এভাবে।। তারপর পৌঁছবো টরেন্টোর কর্ম ব্যস্ত বাস্তব জীবনে ।
মনটা একটু খারাপ হোলো এই ভেবে, আর হয়তো আসা হবে না এই সুন্দর জায়গাটিতে । তারপরও জানি প্রতিবারের মতো এবারো বাড়িতে ঢুকে ছেলে মেয়েদের জরিয়ে ধরে চিৎকার করে বলবো, “ হোম সুইট হোম” ।
আবার শুরু হলো কর্মব্যস্ত জীবন। জীবন কেমন করে এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেললো ভাবতে বসলে বিস্মিত হই। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা কতো বড় হয়ে গেলো । মেয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স শেষ করে ওর ছোট বেলার সপ্ন আইনজীবী হবে সে সপ্ন পুরন করার জন্য সাথে আমাদের আগ্রহে নোভাস্কিয়া প্রদেশের হেলিফেক্স সিটি তে “ ডাল হাউজি” ইউনিভারসিটি তে আইন পড়তে গেলো । এই দেশে মানে ক্যানাডাতে ল এবং মেডিক্যালে সুযোগ পাওয়া খুব সহজ না। সে জন্য খুব ভালো রেজাল্ট করতে হয় ইউনিভারসিটিতে । এদেশে চার বছর ইউনিভার্সিটি শেষ করার পরে “ল” বা মেডিকেলে ভর্তি হবার পরীক্ষা দিতে পারে। মেডিকেলে ভর্তি হতে হলে “ এম কেট “ এবং “ল “তে হওয়ার জন্য “এল সেট” পরীক্ষা দিতে হয়। সে পরীক্ষাও প্রচুর কঠিন ।
পরীক্ষাতেই অর্ধেকের বেশী ছাত্র বাদ পড়ে যায় ।আমাদের মেয়ে সে সুযোগ অর্জন করতে পেরেছে তাই আমরাও অনেক খুশী কিন্তু অনেক কষ্ট মেয়েটা অনেক দূর চলে যাচ্ছে । প্রথম বার আমি এবং ওর বাবা গিয়ে সব গুছিয়ে দিয়ে আসলাম। তারপরও আমি অনেক দিন থেকে গেলাম মেয়ের সাথে ।
মেয়ে ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট দের বিল্ডিঙেই এপার্টমেন্ট নিয়েছে.। সেখান থেকে হেঁটেই ক্লাসে যাওয়া যায় । এদিকে ছেলেও স্কুল শেষ করে ইউনিভারসিটিতে ঢুকেছে । ছেলেও বাসায় থাকে না। সারা বাড়ি খালি। মনটা যেনো বিষণ্ণতায় ভরে গেলো । ছেলে প্রতি শনি রবি বার বাসায় আসে । আমি যেয়ে নিয়ে আসি । মেয়ে আসতে পারে একটু বেশী দিন ছুটি হলে। তবুও মনে শান্তি আমরা একই দেশে আছি। মেয়ে পড়া শেষ হলেই চলে আসবে আমাদের কাছে।
ম্যাল্টন, কানাডা