
সকালে গাড়িতে উঠতে যাবো অমনি দেখি এই প্রাণীটি লেগে আছে গাড়ির দরজায়। এমন পোকা জীবনেও দেখিনি। পোকা কি কেউ দেখে? কিন্তু চোখ সরে না ওর সাদা কালো হলুদ রঙ থেকে। আমার এক সহকর্মী ছিল তার কথা মনে পড়ে গেল। শ্রীলংকান ছেলে। খুবই অল্প বয়স, আমার ছেলের বয়সী। নাম মায়ূর। ওকে দেখতাম কখনো পোকামাকড় মারত না। কাগজের ওপর উঠিয়ে বাইরে গিয়ে গাছের নিচে রেখে আসতো। মানে, বন্যেরা বনে সুন্দর পোকামাকড় গাছ গাছালিতে। আমি মায়ূর হতে পারিনি তবুও পোকাটিকে দেখে মায়া লেগে গেল। যতটা কাছে যাওয়া যায় ততোটা কাছে গিয়ে ছবি তুললাম। একটা না, অনেকগুলো। তিনি একটুও নড়াচড়া করলেন না। দিব্যি বসে রইলেন দুঃখী ভঙ্গিমায়। মানুষ হলে যেন বলতে পারতো আজ যেওনা কাজে। তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
আমিও নাছোড়বান্দা। সকালের মিটিং শেষ করে গুগল করলাম। বিষয়; সাদা কালো হলুদ পোকা। যা পেলাম ছবির সাথে মিলিয়ে দেখলাম। উত্তর এলো, কোন কোন সমাজে বিশ্বাস করা হয় এই জাতীয় পোকা মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে বার্তা নিয়ে আসে।
সে কী? তবে কি চপল পাঠিয়েছিল? কোথায় বাংলাদেশ আর কোথায় কানাডা। চপলের বার্তা নিয়ে এলে তো দিনরাত ওকে উড়তে হয়েছে।
আমার স্ত্রী রোজীর ছোট ভাইয়ের নাম চপল। মাত্র দুই মাস আগে ওর ক্যান্সার ধরা পড়েছে। দুই মাস হয়তো হয়নি, তারও কিছু কম। ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট চপল। রোজী প্রায় প্রতিদিন কথা বলে ওর সাথে। দুই প্রান্তে টেলিফোন ধরে দুই ভাইবোন কেঁদে কেঁদে একে অন্যকে সান্ত্বনা দেয়। কথার মাঝে বারবার উঠে আসে চপলের ছেলেমেয়ে দুটির কথা। বিশেষ করে ছয় বছরের মেয়েটিকে নিয়ে চপলের বেশি চিন্তা। রোজী আশ্বাস দিয়ে বলে, ভয় করিস না চপল। তোর কিছু হবে না। এখন অনেক ভালো ভালো চিকিৎসা হয়। স্টেজ ফোর হলে কী হবে, আমরা তোর কিছু হতে দেব না।
এরই মধ্যে শুরু হলো দেশের অস্থির অবস্থা। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শোক আর ক্ষোভের কথা চারিদিকে। আমি চারদিনের জন্য ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলাম কানাডার শেষ প্রান্তের একটি আইল্যান্ডে। চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়। মাঝে শান্ত নীল হ্রদ। কাজের চাপে ব্যস্ত না হলে অনেক ছবি তুলে পোস্ট করতাম।
এদিকে রোজীর বড় ভাইয়ের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। সেও হাসপাতালে। ফোনের ওপর দিয়ে আমাদের সময় যায়। আরও পরিবর্তন এলো দেশে। ফোন ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেল। আর্মি এলো শহরে। রোজীর নিত্যদিনের রুটিনে পরিবর্তন এলো। সারাক্ষণ ফোনের বাটন টিপে টিপে ক্লান্ত হয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আদরের ভাইটি না জানি কেমন আছে। ম্যাসেঞ্জারে ভাইবোন মিলে গ্রুপে কথা বলতো। ইন্টারনেট সুবিধা না থাকার কারণে কেউ কারোর সাথে কথা বলতে পারছে না। বড় ভাই কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠছেন। ছোট ভাই প্রতিদিন নিস্তেজ হয় যাচ্ছে। মাথার মধ্যে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা।
ট্রেনিং শেষ করে ফেরার পথে ছাত্রদের গুলিবিদ্ধ হবার কথা জানতে পারি। পরের দিন রাত জেগে একটা লেখা শুরু করলাম। যেহেতু অনেক তথ্যই অজানা তাই চেষ্টা করছিলাম যতটা জানা যায়। রাত গভীর হতে থাকে। রোজী ঘুমিয়ে আছে। কেন যেন চপলের জন্য মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। একে ওকে ফোন করেও কারোর সাথে কথা বলা গেল না। খুঁজে খুঁজে চপলের হোয়াটসয়্যাপ নম্বর বের করলাম। শুনেছি হোয়াটসয়্যাপে কথা রেকর্ড করে পাঠালে এখনো শুনতে পায়। ওর স্ত্রীর উদ্দেশ্যে কথা রেকর্ড করলাম। ‘টগর তোমাদের কাউকে পাচ্ছি না তাই ভয়েস রেকর্ড করে পাঠাচ্ছি। চপল কেমন আছে সম্ভব হলে জানাতে চেষ্টা করো। আমি পরে আবার চেষ্টা করবো’। এরপর আবার লিখতে বসলাম। আবার ফোন চেক করলাম। দেখি ইতিমধ্যে ভাগ্নি সুরভী কয়েকবার বিশেষ পদ্ধতিতে চেষ্টা করেছে। সাথে সাথেই ওকে কল ব্যাক করলাম কিন্তু কোন কথা বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর সুরভীর ভাই জুয়েল মন্ট্রিয়ল থেকে টেক্সট পাঠাল ‘ছোট মামা নেই’। বেডরুমে এসে দেখি রোজীর কপালে ভাঁজ অথচ গভীর ঘুমে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমি জুয়েলকে টেক্সট করলাম, তোমার খালাকে সকালে জানাবো।
যতোটুকু পারি ঘুমিয়ে নিলাম। রোজী প্রতিদিন আমার আগে ঘুম থেকে ওঠে। রবিবার তবুও আমি ওর সাথে সাথে উঠলাম। ওর জন্য নাস্তা বানালাম। ও আমার জন্য। ইচ্ছে করেই খাবার টেবিলে ফোন নিয়ে যাইনি। দেখি রোজী ওর ফোন নিয়ে এসেছে। সঙ্গত কারণে ওর ফোনটা হতে নিয়ে লিলাম। বলা তো যায় না কে কখন ফোন করেছিল। সেগুলো দেখে ফেললে সব পরিকল্পনা বৃথা হয়ে যাবে। ও বললো, ফোন হাতে নিলে কেন? খাবার টেবিলে বসেছ একটু কথা বলো। আমিও চুক্তি করে ফেললাম। ঠিক আছে আমি ফোন ধরবো না। তুমিও ফোন দেখবে না।
নাস্তার ফাঁকে ফাঁকে কথা বলি আর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি। এমনি করে এক সময় দু’কাপ কালো কফি তলানিতে এসে গেল। এবার ফোন হাতে নিয়ে মন্ট্রিয়লে জুয়েলের বউকে ফোন করলাম। বললাম কেমন আছ মা। ও কিছু বলছিল তার আগেই আমি বললাম তোমার খালার সাথে কথা বলো। রোজী জিজ্ঞেস করলো কার সাথে কথা বলছ। হ্যাপিকে রোজী খুব পছন্দ করে। ফোন ধরেই উৎফুল্ল কণ্ঠে, হ্যালো হ্যাপি, কেমন আছো মা? স্পিকারে কথা হচ্ছে। হ্যাপি বললো খালাম্মা কিছু শুনেছেন? কী শুনবো মা? হ্যাপির উত্তর ‘ছোট মামা চলে গেছেন’। হ্যাপিকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। যে কাজটা আমি করতে পারলাম না সে সেটা করে দিলো। ফোন রাখার আগে হ্যাপি বললো, তিন ঘণ্টার জন্য কার্ফু উঠিয়ে নিয়েছিল। তখনই দাফন করা হয়।
রোজী পাথর হয়ে গেল। ফোনটা আমার কাছে দিয়ে ডুকরে উঠলো। এতো তাড়াতাড়ি! একটু কথাও বলতে পারলাম না।
প্রবাস জীবনে কতবার আমি ওর চোখ মুছে দিয়েছি। ও আমাকে। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
স্কারবোরো, কানাডা