10.7 C
Toronto
রবিবার, মার্চ ১৬, ২০২৫

মাওয়াই দ্বীপ – আট

মাওয়াই দ্বীপ - আট
মাওয়াই দ্বীপ আট

সময়তো কেটেই যায় সময়ের গতিতে। দেখতে দেখতে আমার মেয়ের তিন বছরের ‘ ল’ পড়া শেষ । লাজিনা আমার মেয়ের অফিসিয়াল নাম। আমরা ওকে বাড়ীতে ডাকি তিন্নি বলে। আমরা সবাই গেলাম মেয়ের ‘ ল’ ডিগ্রীর কনভোকেসানে । মেয়ের সপ্ন পুরন হলো , পুরন হোলো আমাদের আশা । তবে এখানেই শেষ না এক বছর পরে দিতে হবে বার এক্সাম। বার এক্সামে পাশ না করলে কোর্টে যাওয়া যায় না। অন্য কোথাও ‘ল’ এডভাইজার হিসাবে বা অন্য কিছু করতে পারে। অনেকের দুই তিনবার দিতে হয় সে এক্সাম। পরীক্ষা টাও বেশ কঠিন । নয় ঘণ্টা চলে একটানা পরীক্ষা ।আমার মেয়ে বাড়ীতে এসেও বই নিয়েই পরে থাকলো ।

ততদিনে আমাদের নতুন বাড়িটাও শেষ হয়ে গেছে। আমাদের ছেলে তাওসিফেরও পড়া শেষ । কিছুদিন বিশ্রাম করে তারপর চাকুরী খুঁজতে থাকবে। মাঝে মাঝে ভাবতে বসি আমাদের জীবনটাও কতো দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। এখন কেমন জানি মনে হয় ছেলে মেয়ে গুলো ছোট থাকলেই ভালো ছিলো , সারাক্ষণ আমাদের বাবা মায়ের আশে পাশেই ঘুরা ঘুরি করতো । আবার তখন ভেবেছি ইস বচ্চাগুলো যে কবে বড় হবে? যাহোক ছেলে মেয়ের উপস্থিতিতে বাড়ীটা যেনো আনন্দে নেচে উঠলো , ।

- Advertisement -

এখন বাড়ি বদলের পালা, আবারো বাক্স খুলে সব কিছু সাজানো গুছানো । নতুন করে সংসার করা। তবে বাড়ি দেখে ছেলে মেয়েদের ভালো লেগেছে। যার যার ঘর সে সে পছন্দ করে নিয়েছে ছেলে মেয়েরা। এখন আমার কাজ ওদের ঘর গুলো গুছিয়ে দেয়া। আমরা নতুন বাড়ীতে ঢুকলাম একটু তাড়াহুড়ো করেই কারন আমাদের পূরানো বাড়ীটা বিক্রি হয়ে গেছে , নতুন বাড়িওয়ালা এসে যাবে চুক্তি অনুযায়ী তখনি , কাজেই আমাদের বাড়ি না ছেড়ে উপায় ছিলো না। আমরা যখন বাড়ীতে প্রবেশ করলাম তখন এই এলাকাতে শুধু আমাদের বাড়ীটিই দাঁড়িয়ে ছিলো । চারপাশের বাড়ীগুলো তখনো তৈরি হচ্ছে। আমাদের ব্যাক ইয়ার্ডে তখনো পাহাড় সমান উঁচু মাটি , ঘাস লাগানো শুরু হয়নি । ড্রাইভ ওয়েতে ইট পাতা হয়েছে কিন্তু পিচ ঢালা হয়নি। সামনের রাস্তাতেও তাই। তবু আমাদের ভালো লাগছিলো , নতুন বাড়ীর গন্ধ চারপাশে। মনে হচ্ছিল নিজেদের মনের মতো করে বাড়িটি বানাতে পেরেছি।

মেয়ে ‘ ধীরে। ধীরে ‘ বার এক্সাম’ এর জন্য তৈরি হতে লাগলো । আমি ব্যস্ত নতুন বাড়ি নিয়ে। ইচ্ছে হোলো অন্য রকম করে নতুন করে বাড়ি সাজাই। আমি নানা ভাবে নানা ভাবনাতে বাড়ি সাজাতে নেমে গেলাম। বাড়ি বদল সংসার বদল নতুন করে সংসার সাজানো এজেনো আমাদের জীবনের সাথেই জড়িয়ে আছে। অন্য দিকে ব্যাক ইয়ার্ড এর ঘাস বুনন হয়ে গেছে। ড্রাইভ ওয়ে পিচ ঢেলে ঠিক করে দিয়েছে। সামনের রাস্তাও পিচ ঢালা পথ হয়ে গেছে। মিউনিছিপিয়ালটি বাড়ীর সামনের লনে রাস্তা ঘেসে ওদের নিয়ম অনুযায়ী একটি গাছ লাগিয়ে দিয়ে গেলো । প্রতিটি বাড়ির সামনে একটি গাছ লাগিয়ে দেয়া তাদের নিয়ম, সাধারনত একই ধরনের গাছ লাগানো হয় এটা এলাকার সুন্দরয্য বৃদ্ধির জন্য করা হয়। গাছ গুলোর আয়তন মোটামুটি একই সাথে বাড়তে থাকে ।

আরেকদিকে আমার মেয়ের বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেলো । মেয়ের নিজের পছন্দের বাঙালি উপযুক্ত ছেলে তাই আমাদেরও দ্বিমতের কোনো অবকাশ রইলো না। তার মাঝে বিয়ের পান চিনি অত্যান্ত জাঁক জমক ভাবেই হয়ে গেলো । দেশ বিদেশ থেকে আত্মীয় স্বজন সবাই আসলো পান চিনির অনুষ্ঠানে । তারপর মেয়ে ‘বার এক্সাম’ দিয়ে পাস করে গেলো স্মৃষ্টি কর্তার কৃপায় ।

শুরু হয়ে গেলো মেয়ের বিয়ের তোড়জোড় । আমার প্রথম সন্তানের বিয়ে, কোনো কিছুতে যেনো অপূর্ণতা না থাকে সে দিকে সচেতন থাকলাম আমরা। এদিকে লাজিনা একটি ল ফার্মে কাজে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। কাজেই মেয়ে বিয়ের কাজে খুব বেশী মনোযোগ দিতে পারলো না। যা করার আমিই করলাম। নিজের মনের মাধুরী মিশায়ে নিজের জীবনের স্বপ্নগুলো পুরন করলাম মেয়ের বিয়েতে। কোনো কিছুই বাদ রাখলাম না। মনে রাখার মতো বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্য দিয়ে শেষ হোল বিয়ের আচার অনুষ্ঠান ।

মেয়েকে বিদায় দেবার পালা। চোখের জলে বন্যা এনে মেয়েকে তার নিজের সংসারে পাঠালাম । এতো দিন আত্মীয় স্বজনে , বন্ধু বান্ধবে বাড়ীটা আনন্দে ভরপুর ছিলো । যারা পান চিনিতে আসতে পারেনি তার সবাই দূর দুরান্ত থেকেও এসেছিলো বিয়েতে। মেয়ে বিদায়ের পর পর বাড়িটাও একদম ফাঁকা হয়ে গেলো । ছেলে নতুন চাকুরীতে যোগ দিয়ে কাজের জায়গার কাছাকাছি বাসা নিলো । বাড়ীটা আমার শুন্যতায় ভরে গেলো । ছেলেমেয়েদের ঘর গুলো সেভাবেই সাজানো আছে যে ভাবে ছিলো । দেয়াল ভর্তি করে টানানো ওদের বিভিন্ন বয়েসের ছবি। ওদের খালি ঘরগুলোতে যখন আমি যেয়ে দাড়াই তখন বুকের ভেতর একটা হাহাকারের শব্দ বাজতে থাকে আমার। দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে আমার। ছেলে মেয়েকে বুঝতে দেই না। অরা কষ্ট পাবে। বার বার আমাকে বুঝাবে , মা আমরা তো একই শহরে আছি তুমি কেনো এতো মন খারাপ করো বলোতো ছেলে মেয়েরা কি চিরদিন বাবা মায়ের সাথে থাকেছো ? তুমি তো কতো অল্প বয়েসে বাবা মাকে ছেড়ে বিদেশে চলে এসেছো । ছেলে মেয়েরা এভাবে বললে তখন মনকে বুঝাতে চেষ্টা করি।

আজকাল নির্জন দুপুরে ঘুঘু পাখির ডাক আমাকে গভীর বিষণ্ণতায় নিয়ে যায় । নিরিবিলি শহর বলে যে শহরে ঘর বেঁধেছি , এই বাড়ি , এই শহর যেনো আমাকে চারপাশ থেকে গিলে খাচ্ছে। কি ভয়াবহ নিরবতা আমাকে অস্থির করে তুলছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই ,নেই শিশুর ক্রন্দন, নেই গাড়ীর হর্ন , গাড়ীর নীরব চলাচল আছে শুধু গাড়ীর ইঞ্জিন আর চাকার আওয়াজ। তাও শুধু সকাল বিকেলে কাজে যাওয়া আর ফেরার পথে । কথাগুলো শুধু আমাদের মতো এলাকার জন্য। অন্য কোথাও এমন কঠিন নিরবতা নেই। কিছুটা উষ্ণ আবহাওয়া শুরু হলে কিছুটা প্রান ফিরে আসে এই শহরে । মানুষ ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসে বাইরে বাগান করার জন্য। এ দেশের মানুষের বাগানের প্রতি অনেক ভালোবাসা ,আমাদেরও । আমরা যেনো বাগান করার মাঝে খুঁজে পাই আমাদের প্রানের উচ্ছলতা । এরাই যেনো আমাদের মাঝে জাগিয়ে তুলে ভালোবাসার নানা রুপ ।

তবে যতোটা নির্জন শহরে পা রেখেছিলাম সে শহর এখন অনেকটা স্বরব । বাড়ীর সংখ্যা বেড়েছে , লোক সংখ্যা বেড়েছে , বেড়েছে দোকান পাটের সংখ্যা । তারপরও বড় শহরের তুলনায় কিছুই না। নীরবতাটা মানিয়ে নিয়েছি , তাছাড়া নীরবতাকে ভালোবাসার জন্য ই তো এই শহরে আসা । টরোন্ট এলাকাতেই আমরা ছেলে মেয়েরা সবাই আছি। ইচ্ছে হলেই আসা যাওয়া করা যাচ্ছে । ছেলে মেয়েরা আসে সাপ্তাহ শেষে ছুটির দিনে। তখন মনটা ভরে যায় । আমরা ভাবছিলাম অনেক ব্যস্ততা গেলো জীবনে এখন কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়ে শরীর এলিয়ে দিয়ে ঘুরে আসি কোথাও থেকে । অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না। যাযাবর মন চনমন করে উঠলো আমাদের। আমাদের অত্যান্ত ঘনিষ্ট বন্ধু থাকে অ্যালবারটার কেলগেরী শহরে । আমরা একসাথে কুয়েত , সিঙ্গাপুরেও ছিলাম। আমি বিনা দ্বিধায় বলতে পারি,’ মুন্নি ‘ আবেদিন ভাইয়ের স্ত্রী , আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু যদিও অনেক দূরে চলে গেছে ওরা । আবেদিন ভাই আমার স্বামীর ইনজিনিয়ারইং ইউনিভারসিটির বন্ধু যার জন্য আমাদের বন্ধুত্বটা আরো বেশী জমজমাট ।

মুন্নি ও আবেদিন ভাইয়ের ক্রমাগত আমন্ত্রনে আমরা কেলগেরী যাবার সিধান্ত নিয়ে নিলাম। তাছাড়া ওরা আমার মেয়ের পানচিন দুটোতেই অংশ করতে এসেছিলো । ভাবলাম এখন আমাদের দায়িত্ব ওদের ভিজিট করাটা ।টরোন্ট থেকে কেলগেরি তিন ঘণ্টার ফ্লাইট । আমাদের ছেলে মেয়েরাও চাচ্ছে আমাদের ওখানে পাঠাতে , তাহলে আমাদের বিশেষ করে আমার মনটা অনেক ভাল হবে। আমাদের বন্ধুদের জানিয়ে দিলাম আমরা আসছি।

মাল্টন, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles