-5 C
Toronto
বুধবার, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫

শিল্প সাহিত্যের কাগজ সারেঙ

শিল্প সাহিত্যের কাগজ সারেঙ

নিরীক্ষাধর্মী সাহিত্যচর্চার আশ্রয়স্থল হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সাহিত্যে বিবেচিত হয়ে আসছে লিটল ম্যাগাজিন। যদিও লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজ এই শব্দটি অস্বীকার করেন অনেকেই। তাদের অভিমত সাহিত্যচর্চায় ছোট কাগজ বড় কাগজ বলে আলাদা কোন বিষয়বস্তু থাকতে পারে না। যাক এত গভীরে না যাই। মূল কথা সাহিত্যচর্চা। মূলত: নতুনদের সাহিত্যচর্চার সুযোগ করে দেওয়া এবং প্রথাবিরোধী সাহিত্যকে সবার সামনে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়ে থাকে। পুরোনোকে ভেঙেচুরে নতুন কিছু সৃষ্টি করার তীব্র আকাঙ্খার মধ্য দিয়ে এক একটি লিটল ম্যাগাজিনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যদিও নানা কারণে এর বেশিরভাগই অকাল মৃত্যু ঘটে। মূলত: এক একটি ছোট কাগজে লেখালেখি অর্থাৎ কবিতা, ছোটগল্প, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়। এক সময়ে দেশের আনাচে কানাচে অসংখ্য ছোট কাগজ লেটার প্রেসে ছাপা হতো। এ রকম বেশকটি ছোট কাগজের সম্পাদনা করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। সুতরাং এর ভেতরের কষ্ট, এ নিয়ে ক্ষোভ কিংবা প্রকাশের তীব্র আনন্দ মনে এখনও লুক্কায়িত রয়েছে। মূলত: আর্থিক টানাপোড়নে এসব লিটল ম্যাগজিনের নিয়মিত প্রকাশ হয়ে উঠেনি তাই অকালেই ঝরে গেছে। নিরীক্ষা সাধারণত: কোনো প্রতিষ্ঠিত মাধ্যম বা পত্রিকায় করা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। তাই এটার জন্য একমাত্র অবলম্বন লিটল ম্যাগ। লেটার প্রেস শেষে এখন সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ মুদ্রণ মাধ্যমে লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে। তবে নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত ছোটকাগজের সংখ্যা খুব কম। লিটলম্যাগ চর্চা সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়ে বেগবান হয়। বিশেষ করে ষাটের দশকের শুরুতেই এর তীব্রতা ছিলো ব্যাপক। এ সময় প্রথাবিরোধী তরুণদল বেশ কটি লিটলম্যাগ প্রকাশ করে বাংলা সাহিত্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তবে লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আরেকটা বিতর্ক চালু রয়েছে সাহিত্যসমাজে সেটা হলো ওটা লিটল ম্যাগ নয় ওটা লিটল ম্যাগের নামে কলঙ্ক। লিটল ম্যাগাজিনের লেখকরা নাকি অন্য কোনো পত্রিকায় লিখতে পারবে না! এটাও অমীমাংসিত বিষয়। আসলে লিটল ম্যাগাজিনের আন্দোলন বাংলাদেশে হয়নি। লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে আমাদের এখানে পরিষ্কার ধারণা নেই। পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার নামে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আমাদের এখানে প্রতিষ্ঠান নেই বলে আন্দোলনটা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বাংলা সহিত্যে সত্যিকারার্থে লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা আরম্ভ ১৯১৪ সালে প্রকাশিত প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ এর মধ্যে দিয়ে যা মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু তার পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’ (১৮৭২) কে কোনোভাবে অস্বীকার করা যায় না। ইংরেজী ম্যাগাজিন শব্দের অর্থ হলো অস্ত্রাগার, বন্দুক ও রাইফেলের গুলি রাখার খাপ বিশেষ, ক্যামেরা কিংবা প্রজেক্টারে ফিল্ম রাখার স্থান এবং সাময়িকী। সাময়িকী বা ম্যাগাজিন শব্দটি প্রথম চালু হয়েছিলো এডোয়ার্ড কেভ সম্পাদিত দি জেন্টলম্যান’স ম্যাগাজিন সূত্রে। কেভ ছিলেন মূলত: একজন ব্রিটিশ মুদ্রক (প্রিন্টার)। প্রথমে বিভিন্ন গ্রন্থ ও পুস্তিকা থেকে রচনা সংগ্রহ করে বের করতেন ম্যাগাজিন। পরবর্তীকালে মৌলিক রচনা দিয়েই পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। বিখ্যাত ইংরেজ লেখক ও সমালোচক স্যামুয়েল জনসন এর অন্যতম লেখক ছিলেন। লন্ডন থেকে জেন্টলম্যান’স ম্যাগাজিন ১৭৩১ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে ১৯১৪ সন পর্যন্ত টিকে ছিলো। ম্যাগাজিনের প্রথম ধারণার সূত্রপাত হিসেবে মনে করা হয় সংবাদপত্র অথবা গ্রন্থবিক্রেতার ক্যাটালগ থেকে এসেছিলো। ষোড়শ শতাব্দীতে প্রথম ফ্রান্সে এবং পরে অন্যান্য দেশে বিভিন্ন গ্রন্থের সমালোচনা নিয়ে বেরোতো এই ক্যাটালগ। সপ্তদশ শতাব্দীতে সাহিত্যকেন্দ্রিক পুস্তিকা পাম্ফলেট ইংল্যান্ড ও আমেরিকা থেকে নিয়মিত বেরোতো। যা গত শতক পর্যন্ত চলমান ছিলো। এ প্রসঙ্গে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত দি ট্যাটলার এবং দি স্পেকটেটর এর নাম উল্লেখ করা যায়। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন নামের উৎস নিয়ে নানা অনুমান প্রচলিত আছে। কেউ বলেন নামটি এসেছে লিটল থিয়েটার থেকে, কেউ বলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্গারেট এন্ডারসন সম্পাদিত ‘লিটল রিভিউ’ (শিকাগো ১৯১৪) থেকে। ১৮৪০ সালে র‌্যালফ ওয়াল্ডো ইমারসন ও মার্গারেট ফুলার সম্পাদিত ‘দি ডায়াল’ প্রথম লিটল ম্যাগাজিন। অন্যান্য দেশে লিটলম্যাগের ইতিহাস রচনায় যা এখনো উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সত্যিকার লিটলম্যাগ চর্চা শুরু হয় ১৮৮০ সালের পর ফ্রান্সে প্রতিকবাদী সাহিত্য আর যুক্তরাষ্ট্রের রূপবাদী আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে। ১৯২০ সাল থেকে জার্মানীতে এর ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য লিটলম্যাগ হ্যারিয়েট মনরোর পোয়েট্রি (১৯১২), মার্গারেট এন্ডারসনের লিটল রিভিউ (১৯১৪-২৯), ইগোইস্ট (১৯১২-১৯), ব্লাস্ট (১৯১৪-১৫), ইউলিন জোলার ট্রানজিশান (১৯২৭-৩৮)। এজরা পাউন্ড, টি. এস এলিয়ট , জেমস জয়েস, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো বিশ^খ্যাত লেখকরা এসব কাগজে লিখতেন। জয়েসের বিশ^খ্যাত চেতনাপ্রবাহী উপন্যাস ইউলিসিসের প্রথম এগার অধ্যায় ছাপা হয় লিটল রিভিউ’র পাতায়। এলিয়টের বিশ^নন্দিত ওয়েস্টল্যান্ড ছাপা হয় ডায়াল’এ। তাছাড়া প্রধানত অতীন্দ্রিয়বাদীদের দ্বারা চালিত নিউ ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবিদের মুখপত্র এই ‘ডায়াল’ পত্রিকাটি এককভাবে মার্গারেট ফুলারই সম্পাদনা করতেন। এই আন্দোলনটা ফ্রান্সে ‘নো’ আন্দোলন মারফৎ ঘটেছিলো কিন্তু সেখানে গিওম আ্যাপনিয়ার এর মতো মেধা ছিলো। পশ্চিমবঙ্গে হাঙরি জেনারেশনের কবিরা বা লেখকরা প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে কতটা অবদান রেখেছিলেন তা আজ বিতর্কের বিষয়। (তথ্যসূত্র : বিবিক্ত প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ফেব্রুয়ারি ২০০৩)
ষাটের দশকে বাংলাদেশে কণ্ঠস্বর, স্বাক্ষর, সাম্প্রতিক, সপ্তক, কালবেলা, ছোটগল্প, শিকড়, অগত্যা, প্রতিধ্বনি, সবুজপত্র, প্রগতি, শিখা, কল্লোল, কবিতা, পরিচয় ও নাগরিক’র মতো লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হয়। তারা প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো চিন্তার ¯্রােত বাড়ানো। এসব তরুণ লেখক নিজেদের বোধশক্তি ও সাহিত্যভাবনা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার অভিপ্রায় নিয়েই লিটল ম্যাগজিন প্রকাশ করেন। একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ফের লিটল ম্যাগজিন প্রকাশে জোয়ার আসে। একটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি, মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী নানা ধরণের অনিয়ম, না পাওয়ার বেদনা, জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন এবং ভাষার প্রতি মমত্ববোধ ও বাংলা ভাষার সৃজনশীলতা ও গভীরতা ইত্যাদি তরুণ প্রজন্মের ভেতর বিপুল প্রেরণার সৃষ্টি করে। এর পর লোকালয় , অমিত্রাক্ষর, জীবনানন্দ, ঊষালোক, নিরন্তর, একবিংশ, কথা, অনন্যা, দ্যুতি, নান্দীপাঠ, প্রেক্ষিত, বর্তমান, রোদ্দুর, সুন্দরম, লোক, চালচিত্র, দ্রষ্টব্য, অনিন্দ্য, গান্ডীব, প্রসূণ, প্যাঁচা, সংবেদ, লিরিক, শব্দশিল্প, শুদ্ধস্বর, ঘন্টা, শিরদাঁড়া, লাস্টবেঞ্জ ১১৫, নিসর্গ, বিবিক্ত, জনান্তিক, গল্পকথা, শালুক, শব্দপাঠ, বেহুলাবাংলা, ব্যাস, কোরাস, নান্দী, কবিতাপত্র, মধ্যাহ্ন, দ্রাবিড়, মঙ্গলসন্ধ্যা, গ্রন্থী, অক্ষর, ধাবমান, চোখ, মেঘ, অনুশীলন, দৃষ্টি, উতঙ্গ, মৃদঙ্গ, দাগ, মাদুলি, নন্দন, নদী, লেখাবিল, লোকভূমি, কর্ষণ, পর্ব, অরুন্ধতী, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ঘুংঘুর, বেগবতী, জলসিড়ি ইত্যাদি লিটল ম্যাগাজিন বের হতে থাকে। এর বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু বের হচ্ছে এর সাথে আরও কিছু যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যা হাতেগোণা। এক সময় একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে সারা দেশ জুড়ে লিটল ম্যাগাজিনে জোয়ার আসত। মানের বিচারে হয়তবা সেগুলো উঁচু ছিলো না তবে সবার ভেতর সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশেষ চর্চা ছিলো। যতই উৎসাহ থাকুক না কেন এসব লিটল ম্যাগাজিন টিকে থাকে আর্থিক স্বচ্ছলতা ও বিজ্ঞাপনের ওপর। বিশেষ করে প্রাইভেট সেক্টরে যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া লিটল ম্যাগাজিনের অস্তিত্ব বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। এক একটি লিটল ম্যাগাজিন এক সময় স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারত। পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিনের লেখকরা তাদের প্রবন্ধ, গল্প কিংবা কবিতা রচনায় দেশ বিদেশের সমসাময়িক বিভিন্ন অসঙ্গতি খোলাখুলিভাবে তুলে ধরতেন। এর মূল কারণ হলো অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশের অর্থ যোগানদাতা ছিলো বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তাদের দেওয়া বিজ্ঞাপনের ওপর ভর করেই লিটল ম্যাগজিন প্রকাশিত হতো। এটা এখনও অব্যাহত আছে। তবে তার পরিমাণ কমে গেছে। অথচ সময়ের সাথে সাথে দেশে বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দ্রুতবেগে বেড়ে গেছে। এর বেশ কিছু গ্রুপ অব কোম্পানীস। প্রশ্ন হতে পারে তাহলে কেন কমে গেছে লিটল ম্যাগজিন। উত্তর একটাই সেটা হলো, সত্য প্রকাশে বাধা। বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এটাই ভয় পায়। লেখকদের স্বাধীন সত্ত্বাও কমে গেছে। পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিনের সার্কুলেশন কম। প্রচার প্রচারণা সীমিত এসবের। আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসারের ফলে তার বদলে উন্মুক্ত বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যম ও বিভিন্ন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিলে প্রচার প্রচারণা হু হু করে বেড়ে যায়। মোটকথা সময়ের সাথে সাথে এখন কেউ আর চ্যালেঞ্জ নিতে ইচ্ছুক নয়। অথচ বুদ্ধিভিত্তিক দৈন্যতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। সেটা সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
এতক্ষণ লিটল ম্যাগাজিনের সূচনাকাল এবং চর্চা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। এবার শিল্প সাহিত্যের কাগজ ‘সারেঙ’ এর চলতি সংখ্যা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে। ৬ ফর্মার লিটল ম্যাগাজিন সারেঙ ইতোমধ্যে ১৮টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। যা রীতিমত আশাপ্রদ। প্রবন্ধ, কবিতা এবং চমৎকার কিছু ছোটগল্প নিয়ে এবারো প্রকাশিত হয়েছে। লিটল ম্যাগাজিনের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য চলতি সংখ্যায় রয়েছে। আবদুর রহমান মল্লিকের সম্পাদনায় এর প্রতিটি সংখ্যায় সাহিত্যিক-গবেষকদের লেখায় সমৃদ্ধ। যা পাঠকদের চিন্তা শক্তি উসকে দেয়। বিষয় ও ভাবের বৈচিত্র্যে নতুন ভাবনার খোরাক যোগায়। শুরুতেই রয়েছে ঢাকা বিশ^দ্যিালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ আসাদুজ্জামান এর প্রবন্ধ বাংলা ভাষা চর্চার সাম্প্রতিক চালচিত্র। গবেষণামূলক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন ভাষার সাহায্যে স্বাধীনতা কিংবা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাঙালিরা। সারা বিশে^ এটা একমাত্র উদাহরণ। কথাটার মধ্যে অহমিকা আছে কিন্তু বাহুল্য নেই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সুতোর গাঁথুনি শক্ত না হলে বাঙালির স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যেত নিমিষেই। তিনি বলেছেন, মাতৃভাষার জন্য তাজা প্রাণের বিনিময়ের সার্বভৌম অধিকারী যে জাতি তাদের প্রাণের শক্তি সর্বদা অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিনাশী খড়গ। ভাষা এখানে সঞ্জীবনী আধেয়, সর্বাগ্রে অন্যায়কে প্রতিহত করার দুর্বার গতি। প্রবন্ধটা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। আমরা দিন কে দিন আমাদের শিখর ভুলে যাচ্ছি। দেশের প্রতি মায়া কমে যাচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির এই সময়ে দেশের ইতিহাস বিমুখ নতুন প্রজন্ম বড় হয়ে উঠছে। যা রীতিমত আতঙ্কের। লেখক ও সাংবাদিক সৈয়দ তোশারফ আলী লিখেছেন আল্লামা ইকবালের মানবঐক্যের দর্শন। ইকবাল হলেন এক বিষ্ময়কর প্রতিভা। ইকবাল একাধারে কবি ও দার্শনিক। তার চিন্তাধারা যেমন আবেগধর্মী কাব্যে তেমনি যুক্তিধর্মী দর্শনে আত্মপ্রকাশ করেছে। তিনি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন, ছন্দোবদ্ধ ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করেছেন সেখানে তিনি কবি। কিন্তু তার কবিকর্মের মধ্যে তার দর্শন স্ফুরিত হয়েছে। ইকবালের জীবনদর্শন তার কাব্য সমূহের মধ্যেই অধিকতর জীবন্ত মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইকবালের চিন্তাধারা বাস্তবধর্মী। আকাশ-কুসুম কল্পনা বিলাস ইকবালের ধর্ম নয়, মানুষ ও তার ব্যক্তিত্ব সমাজ ও জীবন সমস্যা তার কাব্যদর্শনে বিচিত্র ছন্দ ও সুর ঝঙ্কারে প্রকাশ পায়। ইকবাল মানুষের কবি, মানুষের মধ্যে যে সুপ্ত সীমাহীন সম্ভাবনা রয়েছে তার বাস্তবায়ন কামনা করেছেন তিনি। তার কাব্য মানবজীবনের বিপুল সম্ভাবনার জয়গানে মুখরিত। ইকবাল নিয়ে লেখকের বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধটি চিন্তার খোরাক যোগায়। ভাবার অবকাশ রয়েছে। তিনি বলেছেন. বর্তমান বিশ^ এতোটাই জটিল যে সহজ সমাধান অকল্পনীয়। কোথাও কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে তা নিরসনে নীরব এবং সরব কোনো কুটনীতিই এখন আর তেমন সুফল বয়ে আনছে না। এরপরে সিদ্ধার্থ শংকার জোয়ার্দ্দারের লেখা প্রবন্ধটি হলো ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেমন ছিলেন? এটাও সুখপাঠ্য। সহজ সরল ভাষায় লেখা। শিল্প-সাহিত্য ও গবেষণায় অনন্য আবুল কাসেম হায়দারের লেখা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের আত্মার শক্তি প্রবন্ধটি নতুন করে আমাদের জাতীয় কবিকে চেনাতে সাহায্য করবে। এরপরে রয়েছে আমাদের সংগীত জগতের বিষ্ময়কর প্রতিভা অকালপ্রয়াত সাদি মহম্মদ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার কাউন্সেলর আরেক শহিদ পরিবারের সন্তান শিল্পী রহমানের স্মৃতিচারণমূলক লেখা, সাদি মহম্মদ প্রমাণ করলেন, তিনি ছিলেন। আপাদমস্তক গানের জগতের মানুষ ছিলেন সাদি মহম্মদ। একাত্তরের শহিদ পরিবারে সন্তান সাদি মহম্মদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর অপরাধে সাদি মহম্মদ ও শিবলী মোহাম্মদের বাবাকে অবাঙালিরা নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। সেই স্মৃতি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহন করে গেছেন সাদি। একাত্তরে যাদের পরিবার কোন না কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তারাই বুঝবে একাত্তরের যুদ্ধটা কি ভয়ঙ্কর ছিলো। কি ভয়াবহ ছিলো। স্মৃতিচারণমূলক আরো একটা লেখা হলো কাজী জহিরুল ইসলামের চিত্রশিল্পের দেশে জাহিদুল হক। জাহিদুল হককে আর নতুন করে পরিচয় করে দেবার কিছু নেই। লেখক নানাতথ্য সমৃদ্ধ করে জাহিদুল হককে নতুন করে তুলে এনেছেন। আমাদের সময়কার জনপ্রিয় গান সুবীর নন্দীর গাওয়া ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়/ তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’ তার লেখা। আজ গায়ক এবং গানের রচয়িতা কেউ আর বেঁচে নেই। এটাই বাস্তব। আমরা কেউই থাকব না এক সময়। কিন্তু এমন কিছু ভালো কাজ পৃথিবীতে করে যেতে হবে যেন মনে রাখে কেউ কেউ। তিনি আরও অনেক জনপ্রিয় গানের রচয়িতা। যেমন, কথা দাও কথাগুলো ফেরত নেবে না, স্বাধীনতা তুমি আমার বাড়িতে এসো, যে দেশে বাতাস স্মৃতির স্পর্শে ভারী, কতদিন পরে দেখা ভালো আছ তো ইত্যাদি। গীতিকার হিসেবেই মূলত জাহিদুল হক বিখ্যাত। যদিও তার বেশ কিছু সুখপাঠ্য ও পাঠক নন্দিত কবিতাও রয়েছে। বিশ্লেষণধর্মী এই প্রবন্ধটি জাহিদুল হককে নতুন করে পাঠক জানবে। চলতি সংখ্যা সারেঙ-য়ে কবিতা আছে ২৪ টি। বেশ কিছু কবিতা বহুবর্ণিল। বিষয় বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ কবিতাগুলো বেশ প্রাণবন্ত।
এ সংখ্যায় মাত্র ৪টি গল্প রয়েছে। সব কয়টা গল্পই শিল্পমানসম্মত। এর মধ্যে সুজন বিশ^াসের বন্ধুত্ব নাকি ভালোবাসা সিরিজের শেষসংখ্যাও রয়েছে। গল্প পর্বের শুরুটা হয়েছে ওয়াহিদ জামানের ‘বিনি সূতার মালা’ দিয়ে। গল্পের আঙ্গিকটা অসাধারণ। ভালো লেগেছে। ব্যর্থ প্রেমের গল্প। তৃতীয গল্প ‘দেবী’। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়কার সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। হৃদয়স্পর্শী। পাঠককে ভাবতে শেখায়। এরকম অসংখ্য টুকরো টুকরো ঘটনার ভেতর দিয়ে একটা নতুন দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান নেয়। যারা সে সময়কার তারাই জানে শুধু সে সময়ের প্রকৃত অবস্থা। জনগণের স্বত:স্ফূর্ত যুদ্ধে কোন ঘটনাই ফেলনা নয়। সেটাই আমরা ভুলে যাই। সাজেদা সুলতানা কলি লিখেছেন বেঁচে থাকার লড়াই। সুন্দর হয়েছে। একজন মায়ের চিন্তাভাবনা। কঠিন সংগ্রাম। পরিবার। যা বাস্তবসম্মত। এ সংখ্যায় নতুন সংযোজন , শিক্ষার্থীদের লেখালেখি। এ পর্বে অবনি রেহনুম লিখেছেন সান’স স্কোরচিং এমব্রেন্স এ লুক এট ঢাকা’স হিটওয়েভ। গবেষণামূলক প্রবন্ধ। গরমে অস্থির ঢাকাবাসী। ৪২ ডিগ্রী তাপমাত্রায় হাঁসফাঁস করেছিলো। কিভাবে এর থেকে উদ্ধার সম্ভব তা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেছেন গবেষক।
শুরুতেই আঠারতম সংখ্যায় সম্পাদক নাতিদীর্ঘ একটি সম্পাদকীয় লিখেছেন তাতে সৃষ্টিশীল মননশীল লেখক আবদুর রহমান মল্লিকের পরিমিতবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, সারেঙ হয়ে উঠেছে এক ঝাঁক কবি-লেখকের মিলনস্থল। আসলেই তাই। তিনি শিল্প-সাহিত্যের পত্রিকা হিসেবে সারেঙ কে নানা মাত্রিকতায় নিয়ে যেতে চান। পরিশ্রমী এই সম্পাদক তা পারবেন। তার আশা সারেঙ যেন বাংলা ভাষা চর্চা ও চিন্তার উৎকর্ষ সাধনে সামান্যতম হলেও ভূমিকা রাখতে পারে। সেটা আমরা আশা করতেই পারি।
শিল্প-সাহিত্যের কাগজ হিসেবে সারেঙ এক ব্যতিক্রমি নাম। জীবন-জগতের প্রতি ভাবনার বিস্তার ঘটায়। পাঠককে ভাবুক-রাজ্যে বিচরণ করাতে সাহায্য করে। দিনবদলের পাশাপাশি সমাজ বদলে বিশ^াসী সারেঙ।
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চলে যেতে হয়-প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ ঠিকই বলেছেন। আমরা কেউই এর ব্যতিক্রম নয়। সময়ের প্রবাহে আমরা সবাই ভেসে চলছি। হাঁটার সময় একটা পা পর্যায়ক্রমে ভেসেই থাকে। ঘুমের সময় শরীরটা মরার মতো ঘুমায়। আর জেগে থাকে কি? মৃত্যু ও জাগরণ পাশাপাশি এগিয়ে চলে নিরন্তর। শেষসীমা অবধি। কল্পনা এবং বাস্তবকে নিয়ে এগিয়ে চলে এক একটি জীবন। যারা কাজ করার তারা শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে ঠিকই কাজ করে যায়। যেমন যাবতীয় সংকীর্ণতা শত প্রতিকূলতার মাঝেও সারেঙ নিয়মিত প্রকাশ এর চলার পথ রুদ্ধ করতে পারেনি।
লিটল ম্যাগাজিন নিছক একটি প্রকাশনা নয়। এটি একটি আন্দোলন। মানবতা, জ্ঞান, প্রবল ইচ্ছাশক্তি, সমাজ-রাষ্ট্রকে কিছু ম্যাসেজ এবং প্রজ্ঞার পতাকা ধারণ করে নানা সীমাবদ্ধতা পাড়ি দিয়ে লিটল ম্যাগাজিন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আবারো পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে সেটা হলো অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিনই অর্থের অভাবে অথবা মতানৈক্যের কারণে বেশি দূর যেতে পারে না। তাছাড়া বিকাশমান পুঁজির ক্রমবর্ধমান প্রসারে অলাভজনক কোনো কিছু চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। সাহিত্য বার্তার বাতিঘর সারেঙ এবারের সংখ্যা চমৎকার প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে। সারেঙ সাহিত্যের বিজয় কেতন উড়াবে সেই প্রত্যাশায়।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles