
যখন প্রতি রাতে আমি ঘুমাতে যাই তখন ঘুম খুব তাড়াতাড়ি আসে না বলে প্রতি রাতে আমি বিছানাতে শুয়ে শুয়ে একটি করে গল্প লিখি, লিখি মানে আমি একটা – একটা গল্প আমার মাথাতে ধারন করি । এভাবে ধারন করতে করতে আমার মাথাতে বহু গল্প মৌমাছির চাকের মতো চাক বেঁধে বসে আছে। কিন্তু আমার বড় দুঃখ আমি মৌচাক ভেঙ্গে একটি গল্পকেও আলোর মুখ দেখাতে পারলাম না। সূর্যের আলো বের হবার সাথে সাথে আমার মাথায় মৌচাকের মধ্যে বসে থাকা গল্পগুলো হারিয়ে যায় । কিন্তু আজ ভেবেছিলাম একটা গল্প আমি লিখবোই । কিন্তু হোল না। রিনির গল্প শুনতে শুনতে আমার ভাবনার লেখাগুলো আবার হারিয়ে গেলো ।
রিনির সাথে আমার বন্ধুত্ব , ঘনিষ্ঠতা অনেক বছরের। যদিও ওর চরিত্রের সাথে আমার চরিত্রের কোন ধরনের মিলই নেই। তবুও রিনি আমার বড় কাছের বড় আপন । রিনি আমার বন্ধু।
আর সাতদিন পর রিনির বিয়ে। বিয়ের বাজার করে আমাকে দেখাতে এসেছে । লাল বেনারসি , লাল ওড়না । কতো রকমের প্রসাধনী সাজ গোজের কতো জিনিষ। সেগুলো দেখাতে দেখাতে রিনির মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো । অকারনেই হেসে গড়িয়ে পড়ছে ।
এটা রিনির চার নাম্বার বিয়ে। না একটু ভুল বললাম । তিনটি আসল বিয়ে আর একটি বিয়ে বিয়ে খেলা । আগের বিয়ে গুলো কোন ভাবে কাজী অফিসে গিয়ে হয়েছে বলে তার কনে সাজার ভাগ্য কখনো জোটে নি। কিন্তু এবার রিনির ইচ্ছে সে এবার বউএর মতো করেই সাজবে। পার্লারে গিয়ে এমন ভাবে সাজবে , যেনো সবাই মনে করে এটাই রিনির প্রথম বিয়ে। শুধু তাই না ঘটা করে গায়ে হলুদও করবে।
প্রথম বিয়েটা রিনি প্রেম করে বাবা মায়ের অমতে পালিয়ে করেছিলো । কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই বিয়েটা ভেঙ্গে যায় । রিনির ধারনা হোল তার স্বামী রিপন তাকে অহেতুক সন্দেহ করে। তাকে স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতে বাধা সৃষ্টি করে। সব ক্ষেত্রে তার আধিপত্য দেখাতে চায়। রিনি ভেবে দেখলো এমন সন্দেহ প্রবন মানুষের সাথে জীবন কাটানো কোন ভাবেই সম্ভব না।
তাই যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো তার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতেও রিনির সময় লাগলো না।
রিনি আবার নিজের মতো করে সময় কাটাতে লাগলো । চাকুরি করে নিজের স্বাধীন মতো চলাফেরা করে। হঠাৎ করে রিনির মনে হতে লাগলো , এভাবে একা একা জীবন ধারন করা সম্ভব না। তার জীবনে একজন সঙ্গী অবশ্যই দরকার। সে ভাবনাতে রিনি আবারো প্রেমে পড়লো । রিনি আমাদের দু চারজনকে নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করলো । আমরাও সস্থির নিঃশ্বাস ফেললাম।
নাহ এটাও হোল না। বিয়ের পর রিনির মনে হতে লাগলো বিয়েটা করা তার ঠিক হয়নি। রিনি বর্তমান স্বামী কামাল বড্ড সেকেলে এবং গ্রাম্য মন মানসিকতার একজন মানুষ । বউএর হাতের রান্না খেতে চায় প্রতিদিন। রিনির কোন সময় নেই স্বামীর জন্য রোজ রান্না করার। প্রতি দুই সাপ্তাহ অন্তর অন্তর কামালের সাথে তাদের গ্রামে যেতে হবে তার গ্রাম্য বাবা মা কে দেখতে । তাতেও কি শেষ। মাথায় কাপড় দিয়ে বাবা মা কে পায়ে ধরে সালাম করতে হবে। অসহ্য । রিনি কখনো কাউকে পায়ে ধরে সালাম করে নি। আর এখন কিনা কামাল বাধ্য করছে তাকে এসব করতে। অসম্ভব এমন একটা গ্রাম্য লোকের সাথে কোন ভাবেই সংসার করা সম্ভব না। অতঃপর আবারো বিবাহ বিচ্ছেদ।
আবার চলতে লাগলো রিনির স্বাভাবিক জীবন। রিনি আমাদের জানিয়ে দিলো ও আর বিয়ের ব্যাপারে যাবে না। কিন্তু কতদিন? একজন পুরুষ বন্ধু বা সঙ্গী ছাড়া রিনির জীবনটা বড় পানসে মনে হতে লাগলো ।
রিনি পেয়ে গেলো একজন বন্ধু। বিবাহিত পুরুষ । স্ত্রী আছে কিন্তু স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক খুবই খারাপ। খিটি মিটি অশান্তি লেগেই থাকে। স্ত্রী ঘন ঘন বিবাহ বিচ্ছেদের হুমকি দেয়। ভদ্রলোক খুঁজে বেরাচ্ছিলেন একটি শান্তির জায়গা। যেখানে সে মন খুলে দুঃখের কথা বলতে পারবে । সেখানে এসে অপূর্ণ ভালবাসা পূর্ণতা লাভ করবে।
রিনি ভদ্রলোকের সে স্থানটি করে দিলো । ভদ্রলোকের ভালোবাসায় রিনি ভেসে যেতে লাগলো । বিয়ে না করে, বাচ্চাদের পুতুল খেলার মতো লোকটি রিনিকে তিনবার করে কবুল বলতে বললো , নিজেও বললো । রিনি সে পুতুল খেলার উপর ভিত্তি করে স্ত্রীর মতো আনন্দ সুখের সাথী হতে থাকলো ।
রিনিকে কিছুতেই বুঝানো গেলো না , লোকটি বিবাহিত সে যা করছে সেটা পরকীয়া। পরকীয়া করা লোকগুলো কখনো সৎ এবং সুবিধের হয় না। রিনির একই কথা , সে তাকে কথা দিয়েছে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সে তার পাশে থাকবে। রিনি যেদিন মরে যাবে সে লোক ও নাকি সেদিন মরে যাবে। রিনি তার জীবন। সে লোকটা তাও বলেছে রেজেস্টি করে বিয়ে করার তো কোন দরকার নেই। সেটাতো শুধু একটা কাগজ। ওরাতো জানেই ওরা স্বামী স্ত্রী । রিনি মহা খুশী । তার স্বামীর দরকার নেই। তার এমনই একজন মানুষের দরকার। যে কিনা সব সময় তার পাশে থাকবে। তার সব রকম কাজে এগিয়ে আসবে। তাকে সাহায্য করবে। রিনি অসুস্থ হলে তার পাশে থেকে তার সেবা করবে। এমন একজন বন্ধু না থাকলে ওর বয়েস বেড়ে গেলে কে তার পাশে থেকে হাত ধরে বসে থাকবে। এসব কল্পনা করে রিনির জীবন বেশ ভালোই কাটছিল ।
কিন্তু আবারো ভয়ঙ্কর কালো মেঘ নেমে এলো রিনির জীবনে । রিনির প্রেমিকের স্ত্রী স্বামীর উপর কড়া নজর রাখতে শুরু করলো । তার আচার ব্যাবহারে বুঝতে পারলো তার স্বামী কারো সাথে জরিয়ে পরেছে। তার স্ত্রী তাকে আইনের ভয় দেখালো । বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য উকিলের নোটিস পাঠালো । ভদ্রলোক দিশে হারা হয়ে পরলো । স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে চিরদিন তার গোলাম হয়ে থাকবে বলে প্রতিজ্ঞা করে তার ভালোবাসায় নিজেকে ডুবিয়ে দিলো । বন্ধ করে দিলো রিনির কাছে আসা যাওয়া । কয়েকদিনের মধ্যেই ভুলে গেলো রিনিকে দেয়া তার সব প্রতিজ্ঞা ।
রিনিকে সে লোক সরাসরি জানিয়ে দিলো , তার স্ত্রীকে কাছে পাচ্ছিল না। ঝগড়া ঝাটি হতো বলে রিনির সাথে ভালোবাসার খেলা, স্বামী- স্ত্রী খেলা খেলেছে। এখন তার স্ত্রী তার হয়েছে, রিনিকে তার জীবনে আর প্রয়োজন নাই।
রিনি এই আঘাত সইতে পারলো না। অপমানে ক্রোধে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই তার চলে গেলো । কাজ থেকে দুই সাপ্তাহ ছুটি নিয়ে বিছানাতে পরে থাকলো মরার মতো । কেঁদে বুক ভাসালো । চোখের নীচে ঘন কালো দাগ ফেললো । ডাক্তারের কাছে গেলো , ক্যাউনসেলারের কাছে গেলো । মনের দুঃখ খুলে বললো । ডাক্তারের পরামর্শ মতো ডিপরেসানের ঔষধ খেতে শুরু করলো । তারপরও রিনি সুস্থ হতে পারছিলো না।
রিনি ভেবে নিলো জঘন্য চরিত্রের পুরুষ গুলোকে মরে গেলেও আর পাত্তা দেবে না। গায়ে পরে কথা বলতে আসলেও মুখ ঘুরিয়ে নিবে। ও শুধু এখন থেকে নিজেকেই ভালবাসবে। রিনি এখন পার্লারে যায় । জিমে যায় । মেসেজ করাতে যায়। রিনি এখন পরিপূর্ণ ভাবে নিজেকে ভালোবেসে চলেছে। রিনি প্রতিজ্ঞা করেছে সে কোন দিনও আর কোন পুরুষের দিকে ফিরেও তাকাবে না। আমরাও নিশ্চিন্ত হলাম যাক রিনির সুমতি হয়েছে।
রিনির একা জীবন দিব্বি কেটে যাচ্ছিলো। বছর দুই যেতে রিনির মাথায় আবার চাপলো ওর তো দেখার কেউ নাই। ওর সাথে থাকার কেউ নাই। ওর দায়িত্ব নেবার কেউ নাই। সব বন্ধুদের স্বামী আছে, সন্তান আছে, ওর তো কেউ নেই। বৃদ্ধ বয়েসে কে তার জীবন সাথী হবে? কে ওকে ভালবাসবে? কে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে? একা বাড়িতে পরে মরে থাকলেতো কেউ তার হদিশ পাবে না। নাহ তার জীবনে অবশ্যই একজন সঙ্গীর প্রয়োজন ।
এই প্রয়োজন মিটাতে রিনি ঘটা করে বিয়ে করছে। তার নতুন হবু স্বামীর স্ত্রী মারা গেছে কয়েক বছর আগে। দুটি সন্তান আছে। এতে রিনি আরো খুশী । স্বামী , সন্তান একসাথে পাচ্ছে। ওর নিজের সন্তান হবারতো কোন সুযোগই হোল না।
আমি গালে হাত দিয়ে গম্ভীর মুখে রিনির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম এই বোকা অসুস্থ মেয়েটি কবে বিবাহ নামক অসুস্থতা থেকে বের হতে পারবে । তবে কেন যেনো আমার মনে হচ্ছিল রিনির এই বিয়েটা টিকে যাবে। রিনিরও সে বিশ্বাস। তাই এই বিয়েটা অনেক জাক জমক করে করবে। সে ভাবছে এটাই তার আসল বিয়ে। শ্রেষ্ঠ বিয়ে। দোয়া করি রিনি যেনো তার এবারের স্বামী কে নিয়ে সুখে থাকে।
আমার লেখাটা কিছুটা দীর্ঘ । দীর্ঘ লেখা পড়তে কেঊ ভালোবাসে না ।
ম্যাল্টন, কানাডা