
সমুদ্র সৈকতের পাশেই বিশাল খাবার রেষ্টুরেন্ট আর রেষ্টুরেন্টয়ের বাইরে একটি ড্রিংক পার্লার। যার যার পছন্দ মতো বানিয়ে দেয়া হচ্ছে নানা রকম ফল দিয়ে নানা রকম ফলের রস। কেউ আবার জুসের সাথে অন্য রকম কিছু পানিও মিশিয়ে দিতে বলছে। সমস্যাতো কিছু নেই কোন কিছুর জন্যতো আলাদা করে টাকা দিতে হচ্ছে না। আমি এই যুগের একজন সেকেলে নারী । আমার পছন্দের ড্রিংক হয়ে উঠলো, আমার ভাষাতে যাকে বলবো লেবুর শরবৎ। তাজা লেবু কেটে বেল্ডারে দিয়ে তার সাথে পানি চিনি বরফ কুচি দিয়ে ব্লেণ্ড করে গ্লাসে ঢেলে হাতে দিয়ে দিচ্ছে। আহা বীচে বসে এটা কি যে একটা মজার ড্রিংক। সবাই পানিতে ঝাপাঝাপি করছে আবার পানি থেকে উঠে এসে নানা রকমের পানীয় নিয়ে এসে শুয়ে বসে আরাম করছে। আমিও তাই কোরে যাচ্ছি। বাতাস খাচ্ছি, টুকটাক এটা সেটা খাচ্ছি। আর তাকিয়ে তাকিয়ে মানুষ দেখছি তাদের অনুভূতি গুলো বুঝার চেষ্টা করছি। মানুষ মানুষের কথা বলতে – শুনতে – অনুভব করতে বেশী ভালোবাসে। কারণ সে নিজেকে তার কল্পনার অনুভবের মানুষটার স্থানে বসিয়ে নিজেকে সে মানুষটার মত ভাবতে থাকে।
আমার স্বামী বিজ্ঞ শিক্ষক মানুষ। গাম্ভীর্য্য, ধমক দেয়া, আর সবাইকে ছাত্রভেবে লেকচার দেয়া তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নিজের স্ত্রীকেও শিক্ষয়ত্রী ভাবতে বেশী ভালোবাসেন তিনি। তাঁর মাথায় অনেক চিন্তা। আমার মতো সব কিছু দেখে তিনি আপ্লূত হন না। অহেতুক হালকা আনন্দের চাইতে গভীর চিন্তাতে মগ্ন থাকতে তিনি বেশী ভালোবাসেন। আমরা দু’জন দুই মেরুর মানুষ হোলেও আমাদের ভালোবাসার কোন কমতি নেই। আমার প্রতি কোন অবহেলাও তার নেই। স্ত্রীকে হাসিখুশি রাখার ব্যাপারে তার কোন কৃপণতাও দেখা যায় না। এই শুকনা পাতলা স্বল্প আহারী মানুষটা খাবার দেখতে খুবই ভালোবাসেন। প্রচুর খাবারের সমাবেশ তাকে খুবই পুলকিত করে। স্ত্রীকে নানা রকমের খাওয়ানোর ব্যাপারেও তার প্রচুর আগ্রহ। যদিও এটা মাঝে মাঝে আমার কাছে বিরক্তির ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এখানে এসেও একই অবস্থা। কিছুক্ষণ পর পর নানা রকমের খাবার নিয়ে আসছেন আমার জন্য আবার পরক্ষনেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে গভীর চিন্তাতে মগ্ন হয়ে যাচ্ছেন।
ইস একটু একটু রোদ উঠতে শুরু করেছে। এখন মনে হয় আরাম করে আর বসা যাবে না। আমাদের যে বড় মায়া গায়ের রঙের জন্য। যে কারনে ফেয়ার এন্ড লাভ্লির ব্যবসা এত রমরমা। বাদামী রঙটা যেনো কালো কুচকুচে না হয়ে যায় রোদে পুড়ে সে ব্যপারটা আমাকে খুবই চিন্তিত করলো। শ্বেতাঙ্গদের সে ভয় নাই। রোদ উঠার সাথে সাথে কিছু নর নারী পিঠ উদাম করে উপুড় হয়ে শুয়ে পরেছে। আমি সৃষ্টিকর্তার দেয়া হালকা পাতলা রঙটাকে বাঁচানোর জন্য উঠে গেলাম রেষ্টুরেন্টে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নেবার জন্য।
হরেক রকমের খাবার চার পাশে সাজানো মানুষ তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী খাবার নিচ্ছে খাচ্ছে। আমি খাবারের চারপাশে কয়েকবার ঘুরলাম। কি খাব কি নেবো ভাবছি। অবশেষে প্লেটে কিছু খাবার তুলে নিয়ে এসে বসলাম। যা মুখে দিলাম সবই অখাদ্য লাগলো। অথচ আমার আশেপাশের সবাই কি যে আনন্দ করে খাচ্ছে। আসলে আমি মানুষটা মোটেও খাদ্য সৌখিন না। সব রকম খাবার আমি খেতে পারি না। খাবার শেষ হবার আগেই দেখলাম আকাশে কাল মেঘ জমেছে। তার সাথে হাওয়ার মাতন। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামলো। পানিতে পানি ঝরার অসাধারণ দৃশ্য। আমার পক্ষে ভেতরে বসে থাকা সম্ভব হোল না। বৃষ্টির সাথে মিতালী করার জন্য ছুটে বেড়িয়ে এলাম। সমুদ্র চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ঢেউ গুলো বেশ গুরু গম্ভীর ভাবে ছলাত ছলাত শব্দ করে তীরে ঝাঁপিয়ে পরছে। আমি আমার বয়েসটাকে একত্রিত করে ঢেউয়ে মিলিয়ে দিলাম । আমি ভেবে নিলাম আমি এখন তরুণী।
এতদিন পরে আমি যেনো বৃষ্টিতে ভিজে আমার ছোটবেলাকে আমার হাতের মুঠোতে নিয়ে এলাম। ছোট বেলাতে বৃষ্টিতে ভেজা ছিলো আমার অনেক আনন্দর মাঝে একটি বিশেষ আনন্দ। দুহাত মেলে আনন্দে গেয়ে উঠলাম,’ আজি ঝর ঝর মুখরো বাদল দিনে’। বৃষ্টির বেগে গাছের পাতাগুলো দুলে দুলে নাচছে। গাছের নাচন আমার মনে রিনরিন সুর বাজিয়ে তুললো।‘মম চিত্তে নীতি নিত্তে। কে যে নাচে তা তা থৈথৈ’। আর সে থৈ থৈ অনুভূতি আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে এক অজানা ভালোবাসার ভেলায়। কি আনন্দ কি আনন্দ কি আনন্দ…। আমি ধীরে ধীরে পা ফেলে দুহাত উপরে তুলে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে গেয়ে উঠলাম,’হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে’। আমার দেহ মন সব যেন বৃষ্টির পানিতে স্নান করে এক রকম নতুন পবিত্রতা এনে দিলো । আমি যেন সন্ধান পেলাম এক নতুন জীবনের।
অবশেষে বৃষ্টি কিছুটা কমে আসলো। আমার বৃষ্টির সাথে খেলাও শেষ হোল। কাক ভেজা হয়ে ফিরে এলাম হোটেল রুমে। নিজেকে শুকিয়ে নিতে নিতে দুচোখে ঘুমের মাসী আসন পেতে বসলো। শুয়ে পরলাম একটু সুখ দিবা নিদ্রা নেবো বলে।
ম্যাল্টন, কানাডা