7.9 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ১৪, ২০২৫

মায়া রিভারা : ষষ্ঠ পর্ব

মায়া রিভারা : ষষ্ঠ পর্ব
তাসরীনা শিখা

রুমে এসে কিছুটা ফ্রেস হয়ে আবার খেতে নামলাম। ম্যাক্সিকোন রেষ্টুরেন্টের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছে তাদের নিজস্ব সাজে সজ্জিত দুজন সুন্দরী ললনা। আমাদের কুপন দেখে আমাদের অনেক যতœ করে ভেতরে নিয়ে গেলো। আমাদের নামে নির্ধারিত টেবিলে চেয়ার টেনে আমাদের বসতে দিলো। ন্যাপকিন বিছিয়ে দিলো আমাদের কোলে। মেন্যু দেখে খাবার অর্ডার করলাম। তাবে এখানে ভাষার কোন সমস্যা হোল না আমাদের। তাদের সাথে ভালো করেই বাক্য বিনিময় করা গেল। পরিবেশন কারির মতামত নিলাম কোন খাবারটা আমাদের জন্য সুস্বাদু হবে সেটা জানার জন্য। ছেলেটির কথামতই তাকে খাবার অর্ডার করলাম। অনেক ঝুট ঝামেলা কাটানোর পর বেশ আনন্দ ও তৃপ্তি সহকারে রাতের খাবার শেষ করলাম।

শপিং শব্দটার মাঝে কোথায় জেনো একটা মোহ জড়িয়ে আছে। কোথাও বেড়াতে যাবো অথচ শপিং হবে না এটা কি করে হতে পারে। শপিং এর কথা শুনলে আমার মনের ভিতরে আনন্দ টুনটুনি পাখির মতো হৃদয়ের শাখা প্রশাখাতে লাফাতে থাকে। এটাও এক ধরনের ব্যাধি। আর আমি প্রচণ্ড ভাবে আক্রান্ত এই ব্যাধিতে। আমি জানি না এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পাবার কি পথ। অবশ্য আমার কোন ইচ্ছা নেই এই রোগ থাকে মুক্তি পাওয়ার। এটা আমার মন খারাপকে মন ভালো করার ওষুধ।

- Advertisement -

আজ হোটেল থেকে নিয়ে যাওয়া হবে ডাউন টাউন এবং নানা শপিং এলাকাতে। এই প্রস্তাবে আমার হাত উপরে উঠলো সবার আগে। আমার মতো আগ্রহী ভ্রমনকারিরা বাসে চড়ে বসলাম। হোটেল থেকে ডাউন টাউন বেশ খানিকটা দুরের পথ। প্রথমে আমাদের নিয়ে গেলো সিলভার ফ্যাক্টরিতে। রুপোর জিনিষে ভরা শো রুমটি। সব কিছু ঘুরিয়ে দেখালো সেখানকার লোকজন। তার সাথে সাথে চললো ভ্রমকারিদের কাছে জিনিষ বিক্রির চেষ্টা । মাক্সিকোর রুপা নাকি বিখ্যাত বিশ্বব্যাপী। অনেকেই কেনাকাটা করলো। আর আমাকেতো থাকতেই হবে সে দলে। ফিরে আসার পথে সব মহিলাদের একটা করে রূপোর লকেট উপহার দেয়া হোল। সেটা ছিলো আমাদের উপরি পাওনা।

এখন শুরু হোল আমাদের ডাউন টাউনের পথে যাত্রা। ডাউন টাউনের বিশেষ স্থানে আমদের নামিয়ে বলা হোল ঘুরাঘুরি করে কেনাকাটা করে এবং একটি সময় সীমার মধ্যে আবার এই স্থানে পৌছে যাবার জন্য। আমরা সবাই যারযার মতো এদিক সেদিক ছড়িয়ে পরলাম। সব দেশের ডাউন টাউনের একি চিত্র। কোনটার চাকচিক্য অনেক, কোনটার কম। এখানকার চেহারা চাকচক্য হীন। তবে দোকান অনেক, নানা রকমের। আমরা এদিক সেদিক দোকান থেকে টুকটাক কিছু কেনা কাটা করে , হাঁটতে হাঁটতে একটা ষ্ট্রীটে ঢুকলাম। বিশাল এলাকা নিয়ে দুই পাশে অসংখ্য ছোট ছোট দোকান। নানা রকম স্থানীয় জিনিষে ভরপুর দোকানগুলো। সব চাইতে মজার ব্যাপার দোকানদাররা আমাদের দেখে কেউ বলছে নমস্তে কেউ বলছে সালাম। ওরা চেহারা দেখে বুঝে যায় কাকে কি বলে খুশি করতে হবে। এখানকার মুদ্রার নাম ‘পেছো ‘। বিভিন্ন দোকানে দেখলাম ওরা ইউ এস ডলার গ্রহনে বেশী আগ্রহি। কারন ১ ডলার মানে ২০ পেছো । পেছোর সাথে সাথে ইউ এস ডলারে দাম লিখে রেখেছে সব দোকান গুলোতে। এখানে রেষ্টুরেন্ট গুলোতেও দেখেছি ইউ এস ডলারের প্রতি তাদের আকর্ষণ। আমরাও সেভাবেই ইউ এস ডলারে বকশিস দিচ্ছি সবাইকে। এখানে বকশিসের প্রচলনটা সর্ব ক্ষেত্রে। সব দরিদ্র দেশের একি প্রচলন হয়তো।

আমরা ঘুরতে লাগলাম নানা দোকানে। কিছু যদি না কিনতে পারি তাহলেতো আমার দুঃখের আর শেষ থাকবে না। কিন্তু কিনবো কি করে ? এযে পুরো ফটকা বাজী বাজার। একেকটা জিনিষের আকাশ চুম্বি দাম চাইছে সেও আবার ইউ এস ডলারে। এ ব্যাপারটা আমাদের ছেলে মেয়েরা আসার আগেই আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলো, বলে দিয়েছিলো কি ভাবে দামাদামি করতে হবে ওদের সাথে। আমরা সে পথেই অগ্রসর হলাম। ৪৫ ডলার যেটার দাম চাইলো সেটা কিনতে পারলাম ২০ ডলার দিয়ে, ৩৫ ডলারের জিনিষ দিয়ে দিলো ১০ ডলারে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। এভাবে কি কেনা কাটি করা যায়? তারপরও কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে মনকে আনন্দিত করার জন্য কিছু জিনিষ পত্র কিনে বাসে উঠার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে এসে দাঁড়ালাম। বাসে করে আবার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ক্লান্ত দেহে হোটেলে এসে পৌছালাম।

হোটেলে পৌঁছে রুমে যেয়ে একটু বিশ্রাম করে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। আজ বিশেষ কোন রেস্টুরেন্ট না। নিয়মিত রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। সেখানেও অতিথিদের আদর আপ্যায়নের কোন কমতি নেই। অতিথিদের বসিয়ে ন্যাপকিন মেলে দিয়ে ড্রিংকের অর্ডার নিতে আসে। আজ আমি ভাবলাম এখানে এতো ডাব গাছ, তাছাড়া প্রতিটি গাছে এতো ডাব ঝুলে আছে অথচ একদিনও ডাবের পানি খেলাম না এটা কেমন হোল? আজকে তাহলে ডাবের পানি অর্ডার করি। অর্ডার নিতে আসা ছেলেটাকে জিজ্ঞাস করলাম, তোমাদের’কোকনাট ওয়াটার’ আছে? সে মাথা নেড়ে জানালো আছে। আমি কোকনাট ওয়াটার অর্ডার করলাম। একটু পরেই বরফ দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে আসা হোল আমার আক্ষাকিত ডাবের পানি। আমি আনন্দের সাথে গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিতে লাগলাম। উঁহু এটাতো ডাবের পানির মতো স্বাদ লাগছে না। কি জানি এখানকার ডাবের পানি হয়তো এমন স্বাদেরই। কেমন জানি একটা অন্য রকম গুন্ধ আসছে ডাবের পানি থেকে। ভাবতে ভাবতে আধা গ্লাস ডাবের পানি পান করে ফেললাম।

উঠে দাঁড়ালাম খাবার আনতে যাবো বলে । ব্যাফে খাবার কাজেই নিজে যেয়ে পছন্দ মতো খাবার নিয়ে আসতে হবে। উঠে দাঁড়াবার সাথে সাথে মাথাটা কেমন যেনো ঘুরে গেলো। ভাবলাম সারাদিন রোদে ঘুরাঘুরি করেছি বলে হয়তো এমন লাগছে। খাবারের ওখানে গিয়েও কেমন জেনো একটু তাল হারা মনে হোল নিজেকে । কিছুটা খাবার প্লেটে নিয়ে ফিরে আসতে চাইলাম নিজের টেবিলে। কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেলো আমার টেবিল? এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরছি, সব টেবিলই মানুষ বসে খাচ্ছে। তাহলে আমি কোথায় হারালাম? আমি আমার স্বামীকেও হারিয়ে ফেলেছি। ভাবছি কোথায় গেলো লোকটা?নিজে নিজেই বলছি ‘আই লস্ট মাই হ্যাসবেন্ড’। বেতাল অবস্থাতে কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে খুঁজে পেলাম আমার টেবিল। বুঝতে পারলাম আমি যা পান করেছি সেটা ডাবের পানি না। সেটা অন্য জাতীয় পানীয় যা আমাকে কিঞ্চিত মাতাল করেছে। টেবিলে এসে বসার পর ড্রিংক দিয়ে যাওয়া ছেলেটা আবার ফিরে এলো, এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললো, আমাদের কাছে কোন কোকনাট ওয়াটার নেই। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম ছেলেটার দিকে । তাহলে কি ছিলো গ্লাসে?কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না, আবারো কি ভাষা বিভ্রাটে পরি সে আশংকাতে। যে পানীয়টা খেয়ে আমি কিঞ্চিত মাতাল হয়েছি সেটা হয়তো অন্য কারো ক্ষেত্রে কিছুই হতো না। আমি অভ্যস্ত না বলেই কিঞ্চিত মদ্য পান আমাকে মাতাল করে দিলো। বিরক্ত হলাম নিজের উপরে কেন যে এখানে আসার আগে একটু স্পেনিশ ভাষাটা শিখে আসলাম না, তাহলেতো বারবার ভাষা নিয়ে এমন ঝামেলা হতো না। যাহোক কিছুটা খাবার ধীরে ধীরে খেয়ে একটা সফ্ট ড্রিংক পান করে মাথাটা ঠিক হোল।

খাবার টেবিলে বসে থাকতে থাকতেই একজন লোক সবার টেবিল ঘুরে ঘুরে বলে গেলো, আজ থিয়েটার মঞ্চে ভালো শো আছে আমরা সবাই আমন্ত্রিতি। আমরাও এমনিতেই ভেবেছিলাম আজ যাবো থিয়েটার হলে মঞ্চের শো দেখতে। এই লোকটির আমন্ত্রনে আরো একটু উৎসাহিত হলাম। এখন আমি অনেকটাই সুস্থ। খাবার শেষে এগুলাম থিয়েটার হলের দিকে।

ম্যালটন, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles