0.2 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ১৪, ২০২৫

ছোট বেলায় মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সেরা উপহার

ছোট বেলায় মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সেরা উপহার
ছোট বেলায় মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সেরা উপহার

ছোটবেলায় যখন চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্র তখন আমরা থাকতাম আজিমপুর পার্টিহাউজে। নিউ মার্কেটের ঠিক উল্টো দিকে, একতলা রো হাউজিং, প্রতিটা ঘরের সাথে অন্য ঘর একটার পর একটা গায়ে গায়ে লাগানো। প্রতিটা ঘরে ঢুকবার মুখেই কোন না কোন গাছ থাকতো, আমাদের ছিল বরই গাছ, টক মিষ্টি বরই, মনে পড়লে এখনো জীবে পানি চলে আসে। পাশের বাসায় ছিল বড় একখানি শিউলী ফুলের গাছ, রাত বাড়তে থাকলে ফুলের ঘ্রানও বাড়তো, জানালা খুলে ঘুমোতে গেলে মিষ্টি গন্ধে সারা ঘর ভরে যেতো, ঘুম গভীর হতো, গন্ধের মাদকতায় শরীর-মন হাল্কা মনে হতো। খুব সকালে সারারাত ঘ্রান বিলিয়ে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া ফুলেরা ঘরের সামনেই ঝরে পড়ে থাকতো, যাবার বেলায় অকাতরে রূপের যাদু বিলিয়ে দিয়ে আমাদের জন্য রেখে যেত স্বর্গীয় দৃশ্য। আহা সে কি অপরুপ দৃশ্য, বিনে পয়সায় বছর বছর পেয়েছি। সকাল বেলায় বাড়ীর আঙ্গিনায় শিউলী ফুলের সাদা চাদর। কিছু বাড়ীর সামনে থাকতো আম গাছ তো কারো কাঁঠাল, কারো বাড়ীর সামনে বেল, আতা বা জাম গাছ। সবার বাসার সামনে ছোট করে হলেও একটা বাগান থাকতেই হবে। ভীষন সুন্দর ছবির মত ছিমছাম পাড়া, সামনে খোলা মাঠ, প্রতিদিন সুযোগ পেলেই আমরা খেলাধূলায় মেতে উঠতাম। একটু দূরেই ছিল পুকুর, আমরা দল বেধে সাঁতার দিতাম, ছিপ দিয়ে মাছও ধরতাম। আমাদের পাড়ার রাস্তার ধার ঘেসে সার বেধে ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়ার লাল রং আমাদের মনকে রাংগিয়েছিল সেই ছোট বেলা থেকেই যা আমাদের অনুভুতির জানালাগুলোকে খুলে দিয়ে গেছে বহুদিন আগেই।

পাড়ায় সমবয়সি খেলার সাথীর অভাব ছিলনা। প্রতি বাসায় অন্তত একজন খেলার সাথী থাকতোই থাকতো,

- Advertisement -

খেলাধূলার পাশাপাশি বাগান করা ও পশুপাখি পালনের নেশা বলতে গেলে তখন প্রায় সকলেরই ছিল। আমাদেরও একটা ছোট বাগান ছিল তারপরও অন্য সকলের দেখাদেখি আমিও আম্মার কাছে বায়না ধরলাম মুরগী কিনে দিতে হবে, পালবো।

আব্বা রাজী না থাকলেও আম্মা রাজি হলো, আম্মা একদিন আমার জন্য ভীষন সুন্দর লাল টুকটুকে রং এর দুটো মুরগী এনে দিলো। কি যে সুন্দর রং, সেই বয়সে আমার কাছে মনে হয়েছিল এর চাইতে সুন্দর উপহার এই পৃথিবীতে আর হয়না।আম্মা অনেক খুঁজে অনেক অপেক্ষা শেষে তবেই এই উপহার জোগাড় করে এনেছিল নিজের ছেলের জন্য, যার মাঝে লুকিয়ে ছিল ছেলের প্রতি মায়ের গভীর মমতা। আমি ভীষন আনন্দিত হয়েছিলাম। আমার শিশুমন তখন তৃপ্তির আনন্দে কানায় কানায় পূর্ন। দিনের বিশাল সময় আমার কাটতো মুরগী দুটোকে নিয়ে। আমাদের বাসার সামনে বিশাল খোলা মাঠে তারা ঘুরে বেড়াতো। আমিও তাদের পেছন পেছন চলতাম। মাঝে মাঝে কোলে নিয়েও ঘুরতাম। আমার মুরগী দুটোকে সবাই পছন্দ করতো তাদের সুন্দর রংয়ের জন্য।

হঠাৎ একদিন দুপুরে দেখতে পেলাম আমার একটি মুরগীকে কেউ শ্বাসরোধ করে মেরে আমার পড়ার টেবিলের নিচে ফেলে রেখে গেছে। স্বভাবতই আমি খুব কান্নাকাটি করেছিলাম। আমার শিশু মন তখন বেদনায় নীল, আম্মা অনেক আদর করে আমাকে বুঝালো, মন খারাপ না করতে। আব্বা বাড়ী ফিরে যখন বিষয়টি জানতে পারলো তখন ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। আব্বার যুক্তি ছিল একটাই, মুরগী চুরি হয়নি, মেরে ফেলা হয়েছে যার অর্থ পাড়ার কেউ বিরক্ত হয়েছে বা সমবয়সি কারো হিংসা কাজ করছে, এই মুরগীটিকে আজ যে মেরেছে সেই আবার অন্য মুরগীটিকেও মেরে ফেলবে আগামী যেকোন দিন সুতরাং এটাকে রান্না করে ঝামেলা শেষ করা হোক। ঘর থেকে হিংসা বা ক্রোধের উপাদান দ্রুত বিদায় হোক। অনেক কান্নাকাটি করেও আব্বাকে বুঝানো গেলোনা। পরের দিন ছিল শবে বরাতের রাত। আমার জন্য ছিল ভীষন কষ্টের দিন। আমার শিশু মনের উপর ছুরি চালানো হলো। আমি মনের কষ্টে সেদিন খাবার টেবিলে যাইনি। অল্প সময়ে দুটো মুরগীকে হারিয়ে আমি একা হয়ে পড়লাম। মন খারাপ করে আমার ছোট্ট বাগান নিয়ে পুনরায় ব্যস্ত হলাম, যাতে কষ্টটা ভুলে থাকতে পারি। আম্মা আমার কষ্ট বুঝতে পেরেছিল। আমার মন খারাপ করে থাকা তার জন্যও ছিল অনেক কষ্টের।

এই ঘটনার কয়েকদিন পর রমজান মাস শুরু হলো। ঈদের ঠিক কয়েক দিন আগে দেখলাম আম্মা রিকশায় করে বাসার সামনে এসে থামলো, রিকশার পাদানিতে রাখা এক খানি বাক্স, বাক্সের গায়ে ফুটো ফুটো করা, যাতে আলো বাতাস চলাচল করতে পারে সেই ব্যবস্হা আছে। আমি বড় বড় চোখে তাকিয়ে ছিলাম, আম্মা রিক্সা থেকে নেমে বাসার সামনে এসে বাক্স খুলতেই বেরিয়ে এলো কালো রং এর দুটো মুরগী। এবার কুচকুচে কালো। পালকে আলো পড়তেই হাল্কা নীল রংয়ের আভা ফুটে উঠলো।আম্মা বলল এইযে নাও, তোমার এইবারের ঈদ উপহার, তবে আর লাল রং না, কালো রংয়ের দুটো মুরগী। তুমি মনের আনন্দে তাদের পালতে পারো, নিজের কাছে রাখতে পারো। এদুটোকেও আমার ভীষন পছন্দ হল। আমি আম্মাকে প্রশ্ন করলাম আব্বা আবার খেয়ে ফেলবে না তো? আম্মা অভয় দিয়ে বলল না, তোমার আব্বা সবই জানে, কালো রংয়ের মুরগী কেনার বুদ্ধিতো তারই দেয়া সুতরাং তুমি আর ভয় পেয়োনা। তোমার আব্বা আর কিছু বলবেনা। আমি ভীষন আনন্দিত হলাম। আমরা মনের কষ্ট দূর করবার জন্যই ঈদের আগে এই উপহার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। আমি মনের আনন্দে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে আমার নতুন দুই অতিথিদের কোলে তুলে নিয়ে বাসায় ঢুকলাম। স্বভাবতই আমার পুরো জীবনে আম্মার কাছ থেকে পাওয়া অনেক উপহারের মাঝে এই উপহারটাই সেরা উপহার হয়ে রইল।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles