9 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ১৪, ২০২৫

রিকশাচালক থেকে ইন্দিরা রোডের সুলতান চুন্নু!

রিকশাচালক থেকে ইন্দিরা রোডের সুলতান চুন্নু!
দেলোয়ার হোসেন চুন্নু

এক সময় ছিলেন রাজমিস্ত্রির কর্মচারী, তারপর রিকশাচালক। গার্মেন্টসকর্মী স্ত্রী নাসরিন বেগমকে নিয়ে বসবাস করতেন মিরপুরের তালতলা বস্তিতে। ওই সময় ঢাকায় যার মাথাগোঁজার ঠাঁই ছিল না, তিনিই মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে হয়েছেন শত কোটি টাকার মালিক।

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ফার্মগেটের মতো এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, গাড়ি ও দোকানের মালিক তিনি। গ্রামে গড়েছেন আলিশান দুটি বাড়ি। টাকা কামাতে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী দল গড়েন। কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট ও বিজয় সরণি এলাকায় দাপটের সঙ্গে চালিয়ে যান ছিনতাই কার্যক্রম। ইন্দিরা রোডের ফুটপাত ও লেগুনা স্ট্যান্ডের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণও নেন। এজন্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের আশীর্বাদপুষ্ট স্থানীয় কাউন্সিলর ইরানের ছত্রছায়ায় শুরু করেন শ্রমিক লীগের রাজনীতি। দলীয় পদ না থাকলেও এই রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করেই রিকশাচালক থেকে হয়ে ওঠেন ইন্দিরা রোডের সুলতান! সুলতানি জারি রাখতে ঘটান নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। নাম তার দেলোয়ার হোসেন চুন্নু। তার বিরুদ্ধে করা বিভিন্ন সময় ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজির বিভিন্ন মামলা ঘেঁটে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

- Advertisement -

তবে অতীতের এসব বিষয় অস্বীকার করেছেন দেলোয়ার হোসেন চুন্নু। তিনি বলেন, আমি ১৯৭৯ সালে ঢাকায় আসি। ১৯৮৯ সাল থেকে গাড়ির ব্যবসা করি। মনিপুরী পাড়ায় আসি প্রথম, তারপর থেকে ইন্দিরা রোডে বসবাস শুরু করি। তালতলায় ছিলাম না।

জুলাই-আগস্টে ছাত্রজনতার আন্দোলন দমাতে অস্ত্র হাতে ফার্মগেট এলাকা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। যদিও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরে গা ঢাকা দিয়েছেন ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের এই সরদার। পুরনো সব মোবাইল নম্বর বন্ধ রেখে ব্যবহার করছেন দুবাইয়ের একটি নম্বর। যেটায় শুধু হোয়াটসঅ্যাপেই তাকে সক্রিয় পাওয়া যায়। তার পারিবারিক ও ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গাজীপুরের একটি বাসায় আত্মগোপনে আছেন। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে করতে চাচ্ছেন রফাদফা। সব ঠিকঠাক হলেই ফিরবেন ফার্মগেট এলাকায়।

বিএনপির মাধ্যমে রফাদফা করে ফিরে আসার বিষয়টি স্থানীয় বিএনপির সাবেক ও বর্তমান দুজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তবে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির কমিটি না থাকায় এ বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

আত্মগোপনে থেকে নিয়ন্ত্রণ করছেন ইন্দিরা রোডের লেগুনা স্ট্যান্ড : ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুর হয়ে ধানমণ্ডি ও জিগাতলা পর্যন্ত প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ২০০ লেগুনা চলাচল করে। এসব লেগুনার সব থেকে বড় স্ট্যান্ড হলো ইন্দিরা রোড। এই স্ট্যান্ডে প্রায় ২৫০টি লেগুনা যাত্রী পরিবহন করে। তবে নিয়মিত চলে ২০০টির মতো। প্রত্যেকটি লেগুনা থেকে প্রতিদিন এক হাজার টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয় চুন্নুর নেতৃত্বে। সেই হিসাবে প্রতিদিন দুই লাখ টাকা চাঁদা আসে এই ছোট্ট পরিসর থেকে, যা মাসে ৬০ লাখ টাকা আর বছরে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকার মতো! চুন্নু এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই স্ট্যান্ডের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও চুন্নুর নামে চাঁদা উঠছে প্রতিদিন।

ইন্দিরা রোড লেগুনা স্ট্যান্ডের সভাপতি আব্দুল খালেক বলেন, প্রতিদিন তার নামে লেগুনা থেইকা চাঁদা ওঠে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এলাকার কাউন্সিলরের নামে এইসব করত। আমরা জানি তার (চুন্নু) লগে ওপর লেভেলের লোকজন আছে।

এ বিষয়ে চুন্নু বলেন, আমি ঢাকা শহরে অনেক আগে থেকেই লেগুনার ডিলার। করোনার সময় অল্প দামে কিছু লেগুনা কিনেছিলাম সেগুলো দিয়েই ব্যবসা করি। আমাকে কোনো দিন কেউ বলতে পারবে না কারও কাছ থেকে দশ টাকা নিয়েছি।

ফুটপাতে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ

ফার্মগেটের গ্লোব সেন্টার থেকে টিঅ্যান্ডটি মাঠ পর্যন্ত দুইপাশের ফুটপাতে প্রতিদিন অন্তত ৭০০ দোকান বসে। এসব দোকান থেকেও দিন ও মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা আদায় হয় চুন্নুর নামেই। এখনো এই চাঁদাবাজি চলমান। চুন্নুর হয়ে চাঁদা তোলেন শাহ আলম নামে এক ব্যক্তি। যিনি পাশেই বৈশাখী নামে একটি খাবার হোটেল দেখাশোনা করেন।

মো. রাসেল নামে ফুটপাতের এক ব্যবসায়ী বলেন, আমি তার কাছের লোক, আমার দোকানের জন্যও বিভিন্ন মানুষ দিয়া ভাড়া (চাঁদা) লইত। এ বিষয়ে শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইন্দিরা রোডে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইলে কল দিলেও রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে চুন্নুও কোনো মন্তব্য করেননি।

স্থানীয় ছোট ও উঠতি ব্যবসায়ীদের থেকেও নিতেন চাঁদা। তার অবৈধ রোজগারের বড় একটা অংশ হলো এসব ব্যবসায়ীর থেকে চাঁদা আদায়। ২০১৪ সালে রাজাবাজারে এক ব্যবসায়ীকে পিস্তলের মুখে জিম্মি করে ভয় দেখিয়ে ২০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন চুন্নু। এই ঘটনায় ওই সময় শেরেবাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন মো. ইউনুস আলী নামের সেই ব্যবসায়ী।

তিনি বলেন, আমার কাছে চাঁদা নিছে ২০ লাখ টাকা। আমি মামলাও করছি। ও তো অস্ত্রবাজ ছিল। আমারে অস্ত্র ঠেকায়া চাঁদা নিছে। পশ্চিম রাজাবাজারে আমার অফিসে ঢুইকা আরও সাত-আটজনসহ এই চাঁদা নেয়। ঘটনা ২০১৪ সালে। চাঁদার টাকা আমি ব্যাংকের মাধ্যমে দেই। আমরা জানতাম চুন্নু আওয়ামী লীগ করত, তার সঙ্গে প্রশাসনও ছিল। তার অফিসে ছবি থাকত পুলিশের পলাতক কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ ও বিপ্লব কুমার সরকারের।

এ বিষয়ে চুন্নু বলেন, আমি তো আগেই বলেছি কারও থেকে দশ টাকাও কোনো দিন নিইনি।

গ্লোব সেন্টারে দুটি ফ্ল্যাট ও একটি দোকান

ফার্মগেট ইন্দিরা রোডের গ্লোব সেন্টারে ৮০০ স্কয়ার ফিটের দুটি ফ্ল্যাট ও একটি দোকান আছে চুন্নু ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে। গত ৪ অক্টোবর গ্লোব সেন্টারে চুন্নুর দুই ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তিনি নেই। চারতলার একটি ফ্ল্যাট তালাবদ্ধ; তবে দোতলার অপর একটি ফ্ল্যাটে গিয়ে পাওয়া যায় চুন্নুর দুই মেয়েকে। দুই মেয়ের একজন সোনিয়া রহমান। তার কাছে চুন্নুর বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বলেন, বাবা দীর্ঘদিন ধরে বাসায় থাকেন না। কোথায় আছেন জানি না। তার মোবাইল নম্বরও আমার কাছে নেই।

এসব ফ্ল্যাটের বিষয়ে জানতে চাইলে চুন্নু বলেন, চারতলার ফ্ল্যাটটি আমি ব্যাংক লোন নিয়ে করেছি। সেটি অবশ্য আগেই বিক্রি করে দিয়েছি। দোতলার ফ্ল্যাটটি আমার স্ত্রী কিনেছে। সে থ্রি-পিসের (তৈরি পোশাক) ব্যবসা করে। তার ব্যবসার টাকা দিয়ে দোতলায় ফ্ল্যাটটি কেনা হয়েছে।

লোনের কাগজপত্র আছে কি-না? এমন প্রশ্নের জবাবে চুন্নু বলেন, ‘আমাকে দুদিন সময় দিলে কাগজগুলো দেখাতে পারব।’ তবে চার দিন পেরিয়ে গেলেও এ সংক্রান্ত কোনো কাগজ তিনি দেখাতে পারেননি। বরং সর্বশেষ হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটিও বন্ধ করে রেখেছেন।

দুটো দোকান দখল

গ্লোব সেন্টারের নিচ তলার ৫ ও ১৪ নম্বর দোকান নিজের নামে ও স্ত্রী নাসরিনের নামে ভাড়া নেন চুন্নু। এরপর আর সেই দোকানের ভাড়াও দেন না আবার ভাড়ার চুক্তি শেষ হয়ে গেলে সেটি মালিকের কাছে বুঝিয়েও দেননি। ক্ষমতার জোরে দোকান দুটি দখল করে রাখেন চুন্নু। এই দুটি দোকান নিয়ে গ্লোব সমবায় সমিতিসহ শেরে বাংলা থানা, স্থানীয় র‍্যাব অফিস ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছেও অভিযোগ করেন দোকান মালিক। এসব অভিযোগপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে ২০১৭ সাল থেকে দোকান দুটি জবরদখল করে রেখেছেন চুন্নু।
এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘আমি দোকান কিনেছিলাম আড়াই লাখ টাকায়।’

ছাদে সুইমিংপুলসহ কিশোরগঞ্জে আলিশান বাড়ি

শুধু ঢাকাতেই নয়, নিজ গ্রাম কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। সেখানে ৪৪ শতাংশ জায়গাতে করেছেন একটি বাড়ি এবং পাশেই ২৬ শতাংশ জায়গায় করেছেন দুটি বাড়ি। এছাড়া কিশোরগঞ্জ পলিটেকনিকের পেছনে ৩৬ শতাংশ জায়গা আছে। নামে-বেনামে রয়েছে বিঘায় বিঘায় জমি। স্থানীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪৪ শতাংশ জায়গা জুড়ে এক আলিশান বাড়ি করেছেন চুন্নু। স্ত্রী নাসরিনের ইচ্ছা পূরণ করতে সেই বাড়ির ছাদে করেছেন বিলাসবহুল সুইমিং পুল।

৩ অক্টোবর কথা হয় চুন্নুর গ্রামের অন্তত পাঁচজন প্রতিবেশীর সঙ্গে। তারা বলেন, আগে চুন্নু ও তার পরিবারের মানুষ ঠিকমতো খাবার খেতে পারত না। গত ১৫-২০ বছরে তারা কী এমন করল ঢাকায় গিয়ে যে গ্রামে এসে এত এত জমি ও বাড়ি করতে পারছে। বিশাল সব বাড়ি আর বিঘায় বিঘায় জমি কেনার টাকা কোথা থেকে পেল চুন্নু?

গ্রামের অঢেল সম্পদ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় চুন্নুর কাছে। তিনি বলেন, ‘গ্রামের বাড়িগুলোও ব্যাংক লোন নিয়ে করা হয়েছে। লোনের টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় একটি বাড়ির কাজ বন্ধ হয়ে আছে।’ জমিগুলো তার কি-না জানতে চাইলে বলেন, এগুলোও তার।

এছাড়াও ঢাকার ইন্দিরা রোড ও রাজাবাজার এলাকায় সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি থেকে চাঁদা নেওয়া ও মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকায় জমি দখল করে ভাতের হোটেল দেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। সূত্র : দেশ রূপান্তর

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles