
এমন কেন হয় বল তো?
দুই তিন বছর ধরে ডেঁয়ো পিঁপড়ের মত করে এক পয়সা দু পয়সা যা সন্চয় করি, তা সবই চলে যায় একটা ট্রিপ প্ল্যান করতেই। খুব সাবধানে হিসেব নিকেশ করে, অসীম সাহসের সাথে যখন সেই কাঙ্খিত উড়োজাহাজের একটি আসন বুক করেই ফেলি – তারপর থেকেই বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম বাদ্য বাজতে থাকে। আসন্ন ভ্রমনের উত্তেজনায় রাতের ঘুম তখন ছুঁচোর পেটে।
ভ্রমনের সংক্রান্ত প্রতিটা কাজ, যেমন হোটেল বুকিং, গাড়ী বুকিং, শপিং, ব্যাগ গোছানো- সবকিছুর মধ্যেই একটা আলাদা প্রাণচান্চল্য থাকে। মনটা ফুরফুরে, শরীর খারাপ থাকলেও মজা লাগে। কিন্তু যখনই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে জানালায় উঁকি মারে তখন কেমন যেন একটা অচেনা হাহাকার ভর করে মনের মধ্যে। এখন তুমি বলতেই পারো, তোমার মনের সমস্যাটা কি? অকারনেই উত্তেজিত, অকারনেই বিচলিত। কি আর করব বল, আমার মনে বসত করে আটজনা- তারা নানা কিসিমের মানুষ। তাদের মন যুগিয়ে চলতে হয় সবসময়।
নিজেরে চেনার এই যাত্রায় মন কেমন করার কারনও বের করেছি খুঁজে খুঁজে। আমার প্রতিটা ভ্রমন আমাকে একটু একটু করে পরিবর্তন করেছে। বেড়িয়ে আসার পরের মম আর আগের মমর মাঝে কত কত পার্থক্য। পরের মমগুলি প্রায়ই আগের মমগুলোকে মিস করে। মনে মনে ভাবে, আচ্ছা আগের মমটা কি বেশি আনন্দে থাকত? পরক্ষনেই মনে হয় আগের মমটা বেশি আনন্দে থাকলেও পরের মমটায় শান্তি বেশি আছে। এখনকার মম পৃথিবীটাকে অথবা হয়ত নিজেকেই একটু বেশি বুঝতে শিখেছে।
ভ্রমন মানুষকে বদলায়, ভ্রমনপিপাসু মানুষগুলো তুচ্ছ ঘটনায় বিচলিত না হয়ে বিশাল জানালা দিয়ে উঁকি দিতে জানে। পায়ের নিচে যাঁদের সর্ষেদানা, তারা সমগ্র বিশ্বের নাগরিক হয়ে ওঠে।
তবু যাত্রার সন্ধিক্ষণে হঠাৎ মন কেমন করে ওঠে। প্রতিদিনের তুচ্ছ বিষয়গুলো যেমন গাড়ী, বাসা, বিল কেমন করে যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রতিদিন দেখা মানুষগুলোর গুরুত্বও বোঝা যায় ভিন্নভাবে।এখন যেমন যাবার সময় হল, কেবলই মনে হচ্ছে আমার স্যারের শরীর খারাপ, তিনি কি করবেন? মনে হচ্ছে অফিসের কলিগ, আমার পাগলা বান্ধবীর দল,
বিজনেস পার্টনার ছোট তাহমিদা, চা খাওয়ার সঙ্গী, ঢাকা কাবাব, এমনকি যাঁদের সাথে নিয়মিত ঝগড়া করি তাদের সবার কথা।
অথচ আমার যাত্রা স্বল্প সময়ের জন্যই পরিকল্পনা করা হয়েছে। খুব প্রিয় এই শহরে যখনই বেশিদিন থাকা হয় তখনই অস্থির হয়ে পড়ি। এটা আমার দোষ না, আমার পায়ের তলার সর্ষের দোষ। এবার একটু বেশি সংবেদনশীল হয়েছি কারন খুব প্রিয় চাঁদমুখ এক অনুজ বান্ধবী দোয়া পড়ার লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। আমি আবার খুব বাধ্য মেয়ে। দেয়াগুলো পড়তে পড়তে মনে হল, আমি যদি আর ফেরত না আসি? বিধাতার আশ্চর্য সকল পরিকল্পনা যদি আমার ব্যক্তিগত পরিকল্পনার সাথে মিল না খায়?
তখন কি হইবে? আমি এবং আমার মনে বাস করা আটজন মানুষ সকলেই কিন্চিৎ বিচলিত হলাম এবং আবেগপ্রবণ হয়ে যখনই চোখের কোনে অশ্রু আসি আসি ভাব, তখনই মনে হল- আরে- বিধাতার চেয়ে ভালো পরিকল্পনাকারী আর কে হতে পারে? যত যাই হোক আমি মেনে নেব তার পরিকল্পনা। আর আনন্দে উল্লাসে, ফুর্তিতে বেঁচে থাকব সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা অনুযায়ী। কেন শুধু শুধু চিন্তা করে মাথা নষ্ট করা?এয়ারপোর্ট বসে বসে এইসব হাবিজাবি চিন্তা করছিলাম।
এবারের যাত্রা আমার কাছে খুব অন্যরকম। খুব অল্পদিনের মাঝেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। মন এমনিতেই ছোট হয়ে আছে। আশা করি এই যাত্রা আমাকে আরো পরিনত করে তুলবে। বিধাতার সাথে মিল রেখে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারব।
নিশ্চই আমার সৃষ্টিকর্তা আমার জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটাই দেবেন।
টরন্টো, কানাডা