
‘ক্যাম্পাসে নির্যাতিত ছাত্রীদের জবানবন্দি ও বৈষম্যহীন শিক্ষাঙ্গন গড়ার দায়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীরা। এ সময় নিজেদের নিপীড়নের বেদনা ও সংগ্রামের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা ও কাজি ফারজানা মিম, ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী জয়মা মুনমুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই বিপ্লবের সংগ্রামী সিনথিয়া মেহরিন সকাল ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন।
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার আর্টস অডিটোরিয়ামে ‘শিক্ষা অধিকার সংসদ’ এ ব্যতিক্রমী সভার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের আহ্বায়ক ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রফেসরিয়াল ফেলো অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মনিনুর রশিদ বলেন, ‘শিক্ষাঙ্গন বৈষম্যমুক্ত করতে হলে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের শিক্ষক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে হবে। গণরুম সংস্কৃতি তুলে দিতে হবে। লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবদুল কাদের বলেন, আমাদের নারী সহযোদ্ধারা যখন সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল, তখনই আমাদের বিজয় অর্জিত হয়। তারা যখন সব বাধা ডিঙিয়ে সামনে এসেছিল তখনই ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে।
সভায় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে বিনা অপরাধে এক বছর জেল খেটে সদ্যোমুক্তি পাওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা কীভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুই মামলা থেকে অব্যাহতি পান সে গল্প তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বিনা দোষে জেল খাটার পরও আমার পক্ষে বিভাগের থেকে কেউ দাঁড়াতে পারেনি।
কিছু কিছু শিক্ষকের পক্ষ থেকে যে আচরণ পেয়েছি, তাতে সবচেয়ে বেদনাহত হয়েছি। ভাইভা বোর্ডে যেভাবে প্রশ্ন করে হেনস্তা করা হয়েছে, সেটি আমাকে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত করেছে। আমি এ বেদনার কথা কাউকে বলতে পারিনি।’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেত্রী আমাকে এতটাই নির্যাতন করেছিল যে, আমার কাছ থেকে সুইসাইড নোট লিখে নিয়ে বলে, এবার তোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখব।’ তিনি বলেন, ‘কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন যদি রাজনৈতিক দলের হাতে জিম্মি না থাকে, তাহলে সব শিক্ষার্থীর জন্যই নিরাপদ ক্যাম্পাস তৈরি হবে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কাজি ফারজানা মিম বলেন, ‘আমি প্রথমে যৌনহয়রানির শিকার হই। তখন অভিযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সাহস আমি দেখিয়েছি। যদিও অভিযোগ দেওয়ার পর উল্টো হেনস্তার শিকার হই। বিচারপ্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পরীক্ষায় আমাকে ফেল করানো হয় এবং আমি পুনরায় প্রতিবাদ করি ও নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করাই।’
ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী জয়মা মুনমুন বলেন, ‘১৫ বছর ধরে ছাত্রলীগ হলগুলোয় দখলদারি চালিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের জোর করে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করানো, না গেলে মানসিক-শারীরিক নির্যাতন, জোরপূর্বক অনৈতিক কর্মকাে যুক্ত করানো, ক্যান্টিনে চাঁদাবাজিসহ নানানরকম ঘৃণ্য কাজ তারা করা তো।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাদের এ ধরনের অপরাধের কারণেই শিক্ষার্থীরা সোচ্চার হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। জুলাই বিপ্লবে মায়েরাও ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু বিপ্লব-পরবর্তীতে মেয়েদের কতটা মূল্যায়ন হচ্ছে, সে বিষয়টি ভাবা দরকার।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনথিয়া মেহরিন সকাল বলেন, ‘১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাড়া করে আমার মাথায় রড দিয়ে আঘাত করে। আমার কানে বিকট একটা সাউন্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিচে লুটিয়ে পড়ি। তখন ভেবে নিয়েছিলাম আমি মারা গিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বৈরাচারের পতনে বাংলাদেশের মানুষ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমার ভোগান্তি শেষ হয়নি। মাথার আঘাতের ফল প্রতিদিন সহ্য করতে হচ্ছে। নিজের চঞ্চলতা আর ধরে রাখতে পারিনি। কথা বলতে গেলেও থেমে যেতে হয়। বেঁচে আছি এই ঢের। আমি যে একটা জীবন্ত শহীদ!’
সভায় শিক্ষা অধিকার সংসদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ বলেন, ‘একটা হতাশা থেকে আমরা এ ধরনের একটা প্ল্যাটফরম গড়তে চেয়েছি। শিক্ষা ভেঙে পড়লেও তরুণরা ভেঙে পড়েনি। সেটাই আমাদের আশার পথ।’ সভায় সংগঠনের সদস্যসচিব, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ?ও গবেষণা ইনস্টিটিটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রাজ্জাক, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদী এবং শিক্ষা অধিকার সংসদের নির্বাহী সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।