
সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে সড়ক ও সেতু নির্মাণ থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণসহ সব ধরনের কাজে কমিশন বাণিজ্যের বিশাল সিন্ডিকেট তৈরি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
জানা গেছে, স্ত্রী ইশরাতুন্নেছা কাদের, ভাই আবদুল কাদের মির্জা, ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, নোয়াখালীর সাবেক এমপি একরামুল করিম চৌধুরী ও সাবেক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহকে নিয়ে ওবায়দুল কাদের গড়ে তোলেন দুর্নীতির বিশাল সিন্ডিকেট। তার মন্ত্রীত্বকে অবৈধ ক্ষমতা চর্চার হাতিয়ার করে ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সড়ক পরিবহন খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করে হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছে কাদের পরিবার ও সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা।
এদিকে, ১৬ বছরে ওবায়দুল কাদেরের নিজের নির্বাচনী হলফনামায় দেওয়া তথ্যে সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ পাওয়া গেছে ছয়গুণের বেশি। যদিও হলফামায় দেওয়া টাকার অঙ্কের সঙ্গে বাস্তবের অনেক ফারাক থাকার ইঙ্গিত মিলেছে।
কাদেরের পরিবারসহ সিন্ডিকেটের অন্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য এক আইনজীবী দুদকে আবেদন দাখিল করেছেন। তার আবেদন ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া অভিযোগ আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক গোয়েন্দা অনুসন্ধানে অধিকাংশ অভিযোগেরই সত্যতা পাওয়া গেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের ওই কর্মকর্তা বলেন, ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে বেশকিছু দুর্নীতির অভিযোগ দুদকে জমা পড়েছে। সড়ক ও সেতু নির্মাণ কিংবা পরিবহন ক্রয়ে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দুদকের গোয়েন্দা বিভাগ খতিয়ে দেখেছে। প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ার পর কমিশন থেকে প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে সওজের মোট কাজের ৯০ শতাংশ করেছে ১২-১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো একক ও যৌথভাবে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার কাজ পায়। নানা কৌশলে নির্ধারিত কমিশনের বিনিময়ে সুনির্দ্দিষ্ট ওইসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিত কাদের সিন্ডিকেট। কাকে কাজ দেওয়া হবে, তা আগেই ঠিক করে রাখা হতো। এরপর দরপত্র ডাকার আনুষ্ঠানিকতা করা হতো।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে হাসান টেকনো বিল্ডার্স, রানা বিল্ডার্স, এনডিই, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ, মো. মঈনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড, তাহের ব্রাদার্স, মোহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড, মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ার্স, স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স, এম/এস সালেহ আহমেদ, এম এম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স, রিলায়েবল বিল্ডার্স, তমা কনস্ট্রাকশন, মাহফুজ খান লিমিটেড ও আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন ইত্যাদি।
কাদেরের সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন তার স্ত্রী ইশরাতুন্নেছা কাদের, ভাই আবদুল কাদের মির্জা, ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী ও নোয়াখালীর সাবেক এমপি একরামুল করিম চৌধুরী।
একটি অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, সড়কে চলাচলের জন্য ১৩৭টি বাস কেনার কথা থাকলেও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণ দেখিয়ে ওবায়দুল কাদের তার ক্ষমতার সময়ে দেড় বছর ধরে আটকে রাখে প্রক্রিয়াটি। সূত্রের দাবি, ওবায়দুল কাদের ও সাবেক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরীর পছন্দের প্রতিষ্ঠান কাজ না পাওয়ায় বাস ক্রয়ের প্রক্রিয়াটি আটকে যায়।
বিআরটি কর্তৃপক্ষ সূত্র বলছে, বাস ক্রয়ের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০৫ কোটি টাকা। বাস কেনার জন্য প্রথম দরপত্রে ছয়টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। দ্বিতীয় দরপত্রে অংশ নেয় মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান। প্রথম দরপত্রে বাসগুলো কেনার জন্য সর্বনিম্ন দর ছিল প্রায় ১ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার (১৮৮ কোটি টাকা)। দ্বিতীয় দরপত্রে সর্বনিম্ন দর ছিল প্রায় ১ কোটি ৯১ লাখ ডলার (২০৩ কোটি টাকা)। তৃতীয় দরপত্রে সর্বনিম্ন দর পড়ে প্রায় ৩ কোটি ডলার (৩৬০ কোটি টাকা)।
প্রথম দরপত্রে ছয়টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও বলা হয়, কার্যকর প্রতিযোগিতা হয়নি। পরের দরপত্রে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেওয়ায় এটা কীভাবে কার্যকর প্রতিযোগিতামূলক হচ্ছে, তা নিয়ে ওঠে। আর তৃতীয় দরপত্রে খরচ অনেক বাড়ানো হয়। অভিযোগ উঠেছে, কাদের সিন্ডিকেটের পছন্দের প্রতিষ্ঠান কাজ পায়নি বলেই বারবার দরপত্র আহ্বান করা হয়। শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি ওই প্রকল্প।