
নর্থ ডেকোডার ফারগো শহর । প্রতি বছরেই ভাবি সেখান থেকে ঘুরে আসা উচিৎ আমাদের। এখন ফারগো যাওয়াটা একটা দায়িত্ব হয়ে গেছে। কারন সেখানে থাকে আমার ভাসুরের মেয়ে শীলা তার স্বামী সন্তানদের নিয়ে। সব সময়ই শীলার অনুরোধ , চাচা চাচী আসুন ঘুরে যান এসে আমাদের এখানে। অবশেষে যাওয়ার সিধান্ত হোল । আমাদের ভাবী অথাৎ শীলার মা এসেছেন বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে মেয়ের কাছে। ভাবির সাথে দেখা করতে যাওয়াটাও আমাদের একটা দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ালো । তাছাড়া শীলার অনুরোধ আর ভালোবাসার আকর্ষণ তো আছেই।
যাওয়ার দিন ঠিক করে শীলাদের জানালাম আমরা আসছি। আমার যাচ্ছি শুনে শীলার আনন্দের শেষ নেই। তারপর মনে হয় একটু চিন্তিত হোল । ভাবছিলো আমাদের কতো টুকু ভাললাগবে ওদের ছোট শহরটা। বারবার বলতে লাগলো, চাচী আমাদের শহরটা খুবই ছোট শহর যাকে বলা যেতে পারে ইউনিভার্সিটি শহর । দেখার তেমন কিছুই নাই। আমি জবাবে বললাম তাতে কি? বহু দেশ ঘুরেছি অনেক কিছু দেখেছি, দেখা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। আমরা সবাই এক সাথে হবো , আড্ডা হবে রাত জেগে। অনেক গল্প করবো। অনেক মজা হবে তুমি কিছু ভেবো না।
আমরা টরন্টো থেকে উনিপেগ ফ্লাই করলাম, মানে ক্যানাডার এক শহর থেকে আরেক শহরে । কারন সরাসরি ওদের শহরে যাওয়াটা একটু ঝামেলার ব্যপার ছিলো । যাহোক উনিপেগ এয়ার পোর্ট থেকে আমাদের নিতে আসলো শীলার বর গুলজার আর ওদের ছেলে বিস্ময় । উইনিপেগ থেকে ফারগো তিন ঘণ্টার ড্রাইভ । গুলজার ( শীলার বর) আমাদের নিয়ে গেলো ওর ভাইএর বাড়িতে কিছুতা বিশ্রামের জন্য। সেখানে গুলজারের ভাইরা তাদের পরিবারের সবাই একসাথে হয়েছিলো আমাদের সাথে দেখা করার জন্য। একদম অচেনা মানুষদের আন্তরিকতা আর ভালোবাসায় আমরা মুগ্ধ হলাম। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা ফারগোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। গাড়ীতে বসেই একটা ক্লান্তিময় ড্রাইভিং জন্য তৈরি হয়ে গেলাম।
কিন্তু শহরের রাস্তাটা পার হবার পরই শুরু হোল আমার মুগ্ধতা। একদন খালি রাস্তা । মাঝে মধ্যে দু একটা গাড়ি চোখে পরলেও মনে হচ্ছিলো পুরো পথটাই আমাদের দখলে। দুপাশে অসাধারন সবুজের মেলা। গাড়িতে সিডি বাজছে নানা রকম প্রিয় বাংলা গানের ও রবীন্দ্র সংগীতের । আমি ডুবে গেলাম গানে এবং চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যে । কিভাবে যে তিন ঘণ্টা কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না। যাত্রা শুরু আগে যে ক্লান্তিময় একটা ভাবনা এসেছিলো , বাস্তবে ঘটলো তার বিপরীত ।
পৌঁছে গেলাম শীলাদের বাড়িতে । গাড়ি থেকে নেমে চারপাশে তাকালাম। আহা কি যে সুন্দর এলাকাটা । নিরিবিলি পরিষ্কার পরিছন্ন । প্রতিটি বাড়ির সামনে সুসজ্জিত ফুলের বাগান। এলাকাটা নতুন বলে সবকিছুর মাঝে একটা ঝলমলে ভাব। মনে হচ্ছে সব কিছু যেন নিজেদের আত্মতৃপ্তি নিয়ে সমৃদ্ধ হয়ে আছে।
শীলাদের বাড়িতে ঢুকে মনটা আরো ভালো হয়ে গেলো । সুন্দর করে সাজানো গুছানো শীলার সংসার। শীলা ওর ছেলে মেয়েরা খুব আনুষ্ঠানিক ভাবে আমাদের স্বাগতম জানালো । শীলা আর গুলজারের আদর যত্নের কোন ক্রোটি নাই। আমিও আনন্দের সাথে উপভোগ করতে লাগলাম ওদের আদর যত্ন । আমার সংসারের চিন্তা নেই রান্নার চিন্তা নেই। আমাদের সব কিছুর চিন্তা ওরাই করছে। আমরা খাচ্ছি দাচ্ছি, গল্প গুজব করছি ব্যাক ইয়ার্ডের দোলনায় দোল খাচ্ছি। বিকাল হলে ঘুরতে বের হচ্ছি। কি যে চিন্তামুক্ত জীবন। ফারগোর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখলাম। লেকের পাশে ঘুরে বেড়ালাম । সব কিছুর সাথে মাছ ধরা, বনভোজন কিছুই বাদ পরলো না। তার ফাঁকে ফাঁকে চললো আমাদের চাচি ভাজতির শপিং । শীলা যত টানা আমার ভাজতি তার চাইতে বেশি বন্ধু । আমরা ঘুরে ঘুরে কত কিযে কিনলাম। এক রকম ড্রেস কিনে দুজনে কতো যে ছবি তুললাম ।
তারমাঝে শীলা অর বর মিলে বাসায় আয়োজন করলো একটি সংগীত সন্ধ্যার । শীলার বর গুলজার সেখানকার ইউনিভারছিটির প্রোফেসর । স্বাভাবিক ভাবে ওদের সামাজিক গণ্ডিটা ইউনিভারছিটির সবাইকে ঘিরে। অতিথিরা মোটা মোটি সবাই ছিলো ছাত্র ও শিক্ষক ।ছাত্র ছাত্রীদের গান শুনে মুগ্ধ হলাম। দেশ ছেড়ে এতো দূরে এসেও যে ওরা সংগীত চর্চাটা চালিয়ে যাচ্ছে দেখে ভালো লাগলো । আমার নিজের কিছু লেখা ওদের শুনিয়ে প্রশংসা অর্জন করলাম।
সব চাইতে মজার ব্যাপার ছিলো এই ছোট শহরটিতে শীলার চাচি একজন রূপবতী ও গুণবতী মহিলা।( যদিও আমার দৃষ্টিতে আমি বিন্দু মাত্রও রূপবতী না।) কারণটা ছিলো ওরা মানুষিক ভাবে তৈরি হয়ে এসেছিলো একজন মা। খালা, চাচি যেমন হয় আমি সেরকম একজনই হবো । কিন্তু আমি তার ব্যতিক্রম ছিলাম বলে হয়তো ওদের ভালো লেগেছে।
প্রশংসা শুনতে কার ণা ভালো লাগে। স্বয়ং সৃষ্টি কর্তা ও চান আমরা তাঁর প্রশংসা করি আর আমিতো তাঁর সৃষ্টি করা ক্ষুদ্র একটি প্রাণী । তাই নিজের প্রশংসা শুনে পুলকিত এবং কিছুটা লজ্জিত হোলাম ।
ফিরে আসার দিন এগিয়ে এলো। মনে পড়লো’ নর্থ ডেকোডা স্টেট ইউনিভারসিটি’ টা দেখা হয়নি যেখান থেকে আমার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ পি এইচ ডি ডিগ্রী নিয়েছেন । তাঁর কতো বইতে পড়েছি ফাড়গো শহর আর এই ইউনিভারসিটির কথা । সেটা না দেখে আমরা চলে যাই কি করে ? যে কথা সে কাজ পৌঁছে গেলাম ইউনিভারছিটি ক্যাম্পাসে । গাড়ি থেকে নেমে কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভুতি কাজ করতে লাগলো আমার ভেতরে। এগিয়ে গেলাম মেইন গেটের দিকে। কি অপরুপ রুপে সাজানো প্রবেশ পথ টুকু । মসৃণ পথ চলে গেছে মুল বিল্ডিং এর দিকে। দুপাশে নানা রকম ফুলের সমারোহ । খোলা মাঠে বড় বড় গাছ গুলো তাদের নিজস্ব পরিমিতো আয়তনে ছায়া বিছিয়ে চলেছে । আমরা হেটে চলেছি সে মসৃণ পথ ধরে। হঠাৎ করে চোখে পরলো একটা মানুষ আমাদের চাইতে একটু দূরে হেঁটে চলেছে। চোখে চশমা , হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটছে । আমি থমকে দাড়িয়ে গেলাম। এটা আমি কাকে দেখলাম? এযে লেখক হুমায়ুন আহমেদ । আমার ছুটে গিয়ে তাঁর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করলো । আমার সাথের সঙ্গিরা আমাকে তাড়া দিলো তুমি ওদিকে কোথায় যাচ্ছ? আমরা তো এপথে যাবো । আমি কোন জবাব না দিয়ে ওদের সাথে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। আমার এখনো মনে হচ্ছে তিনি হেটে চলেছেন আমাদের চাইতে একটু দ্রুত গতিতে।
ম্যাল্টন, কানাডা