
মা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত তোমার ডাকে নদী-নালা সাগর-মহাসাগর সাঁতরিয়ে আসতে পারলাম না। এখন সাঁতার দিতে হয় না। তোমাদের একমাত্র ছেলে হাজার হাজার মাইল দূরে চলে এসেছে। এই হাজার মাইল ফিরে যেতে চলিশ আটচলিশ ঘণ্টার বেশি লাগার কথা নয়। শুনেছি আমি জন্ম নেবার সময় তুমি দুদিন প্রসব বেদনায় কষ্ট পেয়েছিলে, গলাকাটা মাছের মত ছটফট করেছিলে। দুই দিন তো আটচলিশ ঘণ্টা সময়। আজ তোমার ডাক পেয়ে আমিও মাছের মত ছটফট করেছি। বুকের ভেতর তীব্র বেদনা অনুভব করেছি। কিন্তু তোমার ও বাবার জন্য চলিশ আটচলিশ ঘণ্টা সময় ব্যয় করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
মা, তুমি বলতে পারো, যতটা পথ ফিরে গেলে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসা যায় না অতটা দূরে সন্তানরা কেন চলে আসে? মায়ের কোল থেকে গেলে কি হয়? আগের দিনে হয়তো কিছু হতো না। এখন কিছুটা হয়। মা কিংবা নানী-দাদী না হয়ে তুমি যদি এ-যুগের সেলি মিলি জলি হতে তবে বুঝতে পারতে কিসের নেশায় তোমাদের সন্তানরা দেশ ছেড়ে অন্যের দেশে চলে আসছে।
লিকু কাকার মেয়ে জলির কথা তো আগেও বলেছি। বাংলাদেশে থাকতে এই জলির ছেলেকে দেখাশুনার জন্য একজন কাজের বুয়া ছিল। তার ওপর জলির বড় খালাও বাচ্চাটির পিছে সারাক্ষণ আঠার মত লেগে থাকতো। তোমাদের কাছে শুনেছি বাচ্চা কোলে নিতে জলি ভয় পেত। সেই জলি আমেরিকাতে এসে এক সঙ্গে চার পাঁচটি বাচ্চার বেবিসিটিং করেছে।
গেল ছয় মাস হলো জলি নতুন কাজ শুরু করেছে। একটি দোকানে বসে পদ্মার ইলিশ, রাজশাহীর পান, যশোরের খেজুরের গুড় বিক্রি করে সে। জলির দোকানে পান-সুপারি সুই-সুতো মাছ-মাংস সবই পাওয়া যায়। তুমি দেখলে মনে করবে হাটের মধ্যখানে বসে বুঝি সে কাজ করছে। এ ছাড়াও জলি আর একটি হাল্কা কাজ করে। সপ্তাহে দুইদিন সে সেলুনে গিয়ে চুল কাটে। জলির চুল কাটা দেখলে আমাদের গ্রামের কানাই নাপিতের ট্যারা চোখও সোজা হয়ে যাবে। কানাই নাপিতের কোন মজুরী ছিল না। খুশি হয়ে যে যা দিত তাই দিয়ে সে চলত। ছোটবেলায় আমিও কানাইয়ের কাছে চুল কেটেছি। তবে হাইস্কুলে যাবার পর থেকে সবসময় ভাই-ভাই সেলুনে গিয়ে চুল কাটাতাম। বাবা কিন্তু কখনো ভাই-ভাই সেলুনে যায় নাই। তোমার চিঠিতে পড়লাম এ-মাসের ছয় তারিখে কানাই এসে বাবার চুল কেটে গেছে। বাবাই নাকি তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। তুমি লিখেছিলে হয়তো এটাই বাবার শেষ চুল কাটা।
ছোটবেলায় জলি ওর মায়ের শাড়ী পরে ছোটাছুটি করতো আর উল্টে পড়তো। এত বড় শাড়ী অতটুকু মেয়ে পেঁচিয়ে রাখতে পারতো না। শুধু যে আছাড় খেত তাই নয়। পড়ে পড়ে হাঁটুতে দাগ বানিয়ে ফেলেছিল। এখন অবশ্য ওর হাঁটুতে কোন দাগ নেই। ছিঃ মা। আমি ওর হাঁটু দেখতে যাব কেন। জলি যে-সব কাপড় পরে তাতে হাঁটু দেখতে অসুবিধা হয় না। তোমরা জলির সাথে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলে। জীবনে প্রথমবারের মত তখন তোমাদের অবাধ্য হয়েছিলাম। জলিকে তুমি ‘লাবুর বউ’ বলেও ডাকতে। একদিন তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কি একটা বিশ্রী কাণ্ড করে ফেলেছিলাম। আমি বললাম, এখন বিয়ে টিয়ে করবো না। বিদেশে যাব। জলিকে বিয়ে করার ভয় না থাকলে হয়তো বিদেশে আসার জন্য অতটা জোর-সোর দিতাম না। যেদিন বিদেশে এলাম তুমি হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চঘাট পর্যন্ত চলে এসেছিলে। কারোর বারণ শুনোনি। কারোর চোখের দিকে তাকাওনি। চোখের দিকে তাকাবার শক্তি তোমার ছিল না। আমি লঞ্চ থেকে দেখেছি তুমি মাটিতে গড়াগড়ি করে কেঁদেছিলে। চার পাঁচজন ধরাধরি করেও তোমাকে উঠাতে পারছিল না।
বাবারও একই অবস্থা হয়েছিল। অবশ্য তোমার মত মাটিতে গড়াগড়ি দেয়নি। এয়ারপোর্টের বড় একটা পিলারের আড়ালে গিয়ে শুধু চোখ মুছেছিল। কি রকম কঠিন লোকটা অথচ শিশুদের মত করে কেঁদেছিল সেদিন। বাবার কষ্ট দেখে মনে হচ্ছিল কারা যেন আমাকে কবরে নামাচ্ছে। এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপছে। আমার মাথার উপর যখন বাবা কাঁপা কাঁপা হাত স্পর্শ কোঁড়ল আমি তখন হাসি হাসি মুখে বলেছিলাম, ‘বাবা বিদায় দাও।’
এখন বাবাকে বিদায় দেবার সময় এসেছে। তুমি খুব করে চাইছ আমি যেন এসে তার মাথার উপর একটু হাত রেখে বসে থাকি। কিন্তু গ্রিন কার্ড না পেয়ে দেশে চলে গেলে আর কোনদিন আমেরিকায় ঢুকতে পারবো না। তার থেকে বড় কথা হলো সুজানকে কে দেখবে? তুমিও চাও আমি যেন দেশে ফিরে না আসি। শুধু বাবার মাথায় হাত রেখে চলে গেলেই হবে এমন করেই লিখেছিলে। অথচ অমনটা করতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। যদি আসতে হয় একেবারেই চলে আসত হবে।
বিদেশে কী আছে জানতাম না। সকলে যাচ্ছে তাই আমিও চলে এলাম। টাকা পয়সার লোভ ছিল না। মনে হয়েছিল আমেরিকায় না আসতে পারলে যদি মাথা হেঁট হয়ে যায়। যদি সিগারেট বিড়ি খেতে শুরু করে দেই। যদি ফেনসিডিলের আড্ডায় শরীক হয়ে যাই। তাছাড়া জলিকে এড়ানো পান্তা ভাতে মরিচ বাটার মত কাজ করেছিল। কি আশ্চর্য দেখ, সেই জলি আর আমি এখন একই দেশে, একই শহরে থাকি। শুধু শহর নয়, একই মহল্লায় থাকি। জলিকে নিয়ে জীবনে সুখী হতে পারব না সেটা ছিল আমার ভুল ধারণা। ওর স্বামী ওকে নিয়ে বেশ সুখী আছে। হাঁটু বের-করা কাপড়গুলো জলির স্বামী নিজেই জলিকে কিনে দেয়। পরিশ্রমী জলিকে নিয়ে সে বেশ গর্ব করে। এ-যুগ তোমাদের যুগের মত নয়। তোমরা স্বামীদের নিয়ে গর্ব করতে। এখন স্ত্রীদের নিয়ে আমরা বড় মুখ করি।
তোমাদের বউও জলির মত ছোট ছোট কাপড় পরে। অবশ্য সে জলির মত ছোটবেলায় লম্বা আর বড়বেলায় ছোট কাপড় পরতে শিখেছে তা কিন্তু নয়। এরা বরাবর ছোট কাপড় পরেই অভ্যস্ত। এদের মা-খালারাও তাই পরে। সুজান তোমাদের দেখতে চেয়েছিল। বলেছিল বাংলাদেশে গিয়ে তোমাদের সাথে ও দেখা করবে। এখন ওকে যেকোনো সময় হাসপাতালে নিতে হতে পারে। ছেলে হোক আর মেয়ে হোক ডাক্তার বলে দিয়েছে এক সঙ্গে ওর দুটো বাচ্চা হবে। তাও সিজারিয়ান।
মা, এখন হয়তো বুঝতে পারছ কি কারণে তোমার লাবু ঘরে ফিরে আসছে না। বাবা খোলা জানালা দিয়ে যতই মাঠের দিকে চেয়ে থাকুক না কেন আমাকে দেখতে পাওয়া এখন অনেক কঠিন। চাঁদ দেখতে পাওয়া হয়তো সহজ কিন্তু বিদেশে চলে আসা ছেলের দেখা আকাশের নাই তারার মত। যে ছেলে আকাশ দিয়ে হারিয়ে গেছে সেই ছেলে আকাশের হয়ে গেছে। মাটির নিচে হারিয়ে গেলে যেমন মাটির হয়ে যায়, আকাশের পথে হারিয়ে গেলে তেমনি আকাশের।
তোমরা যে আকাশের দিকে সারাক্ষণ চেয়ে থাকো, আমি সেই আকাশের দিকে ভয়ে তাকাতে পারি না। আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় আমার দুই হাতের মুঠিতে দুমুঠো মাটি। মাটি হাতে নিয়ে আমি থরথরিয়ে কাঁপছি আর তুমি সান্ত্বনা দিয়ে বলছ, ‘বাবা, দূর থেকে বিদায় দাও।’
আমি শুনতে চাই না কোন বিদায়ের বাণী। আব্দুল মালিক চাচাকে বলো তিনি যেন উপরের মালিকের কাছ থেকে একটি চিঠি এনে বাবার হাতে দেন। যাতে লেখা থাকবে ‘প্রস্থান বিলম্বিত’।
ইতি
তোমার হতভাগা, লাবু
স্কারবোরো, কানাডা