7.3 C
Toronto
শনিবার, মার্চ ১৫, ২০২৫

পার্টি ড্রাগে অভিনেত্রী, শিক্ষার্থী, উচ্চবিত্ত

পার্টি ড্রাগে অভিনেত্রী, শিক্ষার্থী, উচ্চবিত্ত
অভিনেত্রী সাফা কবির এবং মুমতাহিনা চৌধুরী ওরফে টয়া তানজিন তিশা এবং সংগীতশিল্পী সুনিধির সম্পৃক্ততা উঠে আসার পর ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে

ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর ছেলে আরিয়ান আরাফাত। নামকরা একটি কলেজ থেকে এইচএসসি’র পাঠ চুকিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ২০১৮ সালে চলে যান মালয়েশিয়া। সেখানে বছর খানেকের মধ্যে পরিচিত হন এমডিএমএ বা পার্টি ড্রাগসের সঙ্গে। বন্ধুদের সঙ্গে শখের বশে শুরু করলেও একসময় তিনি প্রতিরাতেই এমডিএমএ সেবন করা শুরু করেন। এতে করে একদিকে তার লেখাপড়ায় যেমন স্থবিরতা আসে, তেমনি অর্থনৈতিক ক্রাইসিসও বেড়ে যায়। ঢাকা থেকে লেখাপড়া, থাকা খাওয়া এবং হাত খরচের যে খরচ পাঠানো হতো এক বছরের মাথায় সেই খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। প্রতি সপ্তাহেই তাকে বড় অঙ্কের টাকা পাঠানো হতো। এমডিএমএ ছাড়াও তিনি কুষ, এলএসডিসহ আরও অনেক মাদকের প্রতি ঝুঁকে যান। মাদকে আসক্ত হওয়ার পর যতবার ঢাকায় এসেছেন ততবারই বিভিন্ন কৌশলে দেশে এলএসডি, এমডিএমএ নিয়ে এসেছেন। পরে সেগুলো বন্ধুদের সঙ্গে সেবন করে গুলশান, বনানী ও উত্তরা এলাকার বিভিন্ন পার্টিতে অংশগ্রহণ করে রাতভর আনন্দফূর্তি করে সময় কাটিয়েছেন। ব্যয়বহুল এসব মাদক প্রথমদিকে বন্ধুদের ফ্রি খাওয়ালেও একসময় বন্ধুরাও এসব মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন। বাড়তে থাকে তাদের চাহিদা। কিন্তু দেশে এ মাদকের সরবরাহ খুব গোপনে ও সীমিত পরিসরে হওয়ায় তারা বিপাকে পড়েন। পরে আরিয়ান বিভিন্ন মাধ্যমে মালয়েশিয়া থেকে এসব মাদক দেশে আনাতেন এবং সেগুলো বন্ধু-বান্ধব পরিচিত মহলে বিক্রি করতেন। কেনা মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করে তিনি লাভবানও হয়েছেন। একসময় তার বড় একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়ে যায়। লেখাপড়ার আড়ালে দীর্ঘদিন এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। একসময় তিনি ঢাকার অভিজাত মহলেও পার্টি ড্রাগ সরবরাহ করতেন। সাম্প্রতিক সময়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের হাতে দীপ নামের এক শিক্ষার্থী গ্রেপ্তারের পর থেকে তিনি গাঢাকা দিয়েছেন। মাদক নিয়ে কাজ করেন এমন সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে খুঁজছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে মাদককাণ্ডে তিন অভিনেত্রী ও সংগীত শিল্পীর সম্পৃক্ততা উঠে আসার পর ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। ডিএনসি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শুধু অভিনেত্রী, সংগীত শিল্পীরা নয় ঢাকায় পার্টি ড্রাগের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। হোটেল, বার, বিভিন্ন ঘরোয়া পার্টিতে এখন জনপ্রিয় নাম এমডিএমএ। এসব পার্টিতে যারা অংশগ্রহণ করেন, তাদের কম বেশি সবাই পার্টি ড্রাগ সেবন করেন। তবে খুব গোপনে এই ড্রাগটি কেনাবেচা করা হয়। যারা বিক্রি করেন আর যারা কেনেন তারা খুবই সতর্ক। এ ছাড়া দেশে এই ড্রাগটি যারা নিয়ে আসেন তারাও বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন।

- Advertisement -

ডিএনসি’র ঢাকা মেট্রো উত্তরের কর্মকর্তারা জানান, এমডিএমএ বা পার্টি ড্রাগ, এলএসডি, কুষসহ সেবন ও বিক্রি করেন এমন বেশ কয়েকজনকে দীর্ঘদিন ধরে তারা নজরদারিতে রেখেছিলেন। এদের প্রায় সবাই অভিজাত শ্রেণির। তাদের মধ্যে বিদেশ ফেরত শিক্ষার্থী, ঢাকার নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সন্তানরা ছিলেন। নজরদারি করতে গিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সন্ধান পাওয়া যায়। ওই গ্রুপের মাধ্যমেই সবাই মাদক সংগ্রহ করতেন। তাদের মধ্যে কেউ এলএসডি, কেউ কুষ এবং এমডিএমএ সংগ্রহ করতেন। এরই সূত্র ধরে পাওয়া যায় নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির মার্কেটিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী অরিন্দম রায় দীপের। সে মূলত ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের এডমিন। পরে তাকে আলাদাভাবে নজরদারি করে ১৭ই অক্টোবর ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সিসা, এমডিএমএ, এলএসডি ও কুষ উদ্ধার করা হয়। পরে ডিএনসি’র ঢাকা মেট্রো উত্তরের কর্মকর্তারা তাকে দুইদিন জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তার কাছ থেকেই সন্ধান পাওয়া যায় অভিনেত্রী সাফা কবির এবং মুমতাহিনা চৌধুরী ওরফে টয়া, তানজিন তিশা এবং সংগীতশিল্পী সুনিধি’র। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ চারজনই দেশের পরিচিত মুখ। তাদের বিষয়ে ব্যাপক তদন্ত খোঁজখবর নিয়ে সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে কিছু জটিলতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে নির্দেশনা আসার পর তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে ইতিমধ্যে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে অনেক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের নিজের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর থেকে চ্যাট, মাদকের অর্ডার করার স্ক্রিনশর্ট, কল রেকর্ড পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এ ছাড়া তাদের মোবাইল নম্বরের রেজিস্ট্রেশন চেক করে দেখা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, শুধু এই অভিনেত্রী নন তদন্তে নেমে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যলয়ের এক নারী শিক্ষকের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। যদিও তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্ত কর্মকর্তারা থানায় জিডি করেছেন। শিগগির তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিমানবন্দরে কর্মরত সংস্থাদের ফাঁকি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া থেকে এসব ভয়ঙ্কর ড্রাগ দেশে আনছে কয়েকটি চক্র। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ওইসব দেশে লেখাপড়ার উদ্দেশে যাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। তারা লেখাপড়া করতে গিয়ে সেখানে ওইসব মাদকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে পরে দেশে আনা শুরু করেন। ছড়িয়ে দেন বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতদের মধ্যে। ব্যয়বহুল হওয়াতে মূলত উচ্চবিত্তরাই এসব মাদকের প্রতি ঝুঁকছেন। বিগত কয়েক বছরে দেশে বড় একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে এসব মাদকের। নানা গোপনীয়তা বজায় রেখে কেনাবেচা করা হয়। কেনাবেচার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। এটি ইয়াবার উপকরণ মেথাএমফিটামিনের মতোই অতি উত্তেজক মাদক। এটি মানবদেহে এমন একটি শক্তিশালী প্রভাব তৈরি করে, যাতে সময় এবং উপলব্ধি জ্ঞানের বিচ্যুতি ঘটে। তবে অনেক সময় এটি শান্তি, আনন্দ, সহানুভূতি এবং এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের বর্ধিত অনুভূতি তৈরি করে।

মাদক নিয়ে কাজ করেন এমন কর্মকর্তারা বলেন, কয়েকদিন পরেই থার্টিফার্স্ট নাইট উদ্‌যাপন করা হবে। এজন্য বাসা বাড়ি থেকে শুরু করে তারকা হোটেল, ছোট বড় রেস্টুরেন্ট, ক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে পার্টির আয়োজন করা হবে। রাতভর এসব আয়োজনে পার্টি ড্রাগের ব্যবহার হবে। এজন্য কয়েকটি চক্র বিভিন্ন মাধ্যমে দেশে এনেছেন পার্টি ড্রাগ। তবে এসব ড্রাগ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক তৎপরতা থাকায় সেবনকারী ও বিক্রেতারা সতর্ক। থার্টিফার্স্টকে ঘিরে চাহিদাও বেড়েছে ব্যাপকভাবে। তবে তাদেরকে ধরার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত আছে। কর্মকর্তারা বলেন, বিদেশ থেকে এসব মাদক আনতে গিয়ে মিথ্যা ঘোষণা দেয়া হয়। বিভিন্ন ধরনের খাবারের আড়ালে এসব মাদক আনা হয়। বিমানবন্দরের স্ক্যানার দুর্বল থাকায় স্ক্যানিংয়ে এসব মাদক ধরা পড়ে না।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো উত্তরের সহকারী পরিচালক রাহুল সেন মানবজমিনকে বলেন, শুধু ওই অভিনেত্রীরা নন আমরা আরও অনেকের সম্পৃক্ততা ও বিস্তারিত পেয়েছি। সমাজের হাইপ্রোফাইল অনেকেই জড়িত। এসব নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবো।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles