
লোকটা যে একটা ইতর সে কথা ছোট বড় সকলে জানে। বিনা নোটিশে কথার মধ্যে ঢুকে পরিবেশটা আলুভর্তা বানিয়ে দেবে। মানুষের সাথে এমনভাবে কথা বলবে যেন চাকুরীর ইণ্টারভিউ নিচ্ছে। ধরুন আপনি কোন লোকের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সাথে সাথে তার দিকে ঘুরে, বসাটাকে আরো মজবুত করে নিয়ে একটার পর একটা তীর ছুড়বে। ক্যানাডায় কবে এলেন? কিভাবে এলেন? কোথায় কাজ করেন? কিভাবে কাজটা পেলেন? কত বেতন পান, ইত্যাদি। একদিন এক ভদ্রমহিলাকে প্রশ্ন করে বসলো, দেশ থেকে কতদূর পড়াশুনা করে এসেছেন? ভদ্রমহিলা তো একদম আকাশ থেকে পড়ল। এমন প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দেবেন সেটা চিন্তা করতে না করতে আরও একটি প্রশ্ন উড়ে এলো। আপনাকে দেখে তো বেশ অল্পবয়স্ক মনে হচ্ছে। আপনার বয়স কত? ভদ্রমহিলার স্বামী একটি ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। ম্যাগাজিন থেকে চোখ সরিয়ে চশমার উপর দিয়ে লোকটিকে এক পলক দেখে নিলেন। তারপর আবার ম্যাগাজিনে ফিরে গেলেন।
যে লোকটিকে এতক্ষণ যাবৎ ইতর ইতর বলে যাচ্ছি তার নাম কাবুল। আফগানী কিংবা পেশোয়ারীদের মত পায়জামা-কুর্তা পরে। পায়ে জরি দেয়া কাবলি জুতো পরে মচমচ শব্দ করে হাঁটে। কাবুল সাহেবে দেশ ছাড়ার আগে কয়েকবার করে এস.এস.সি. আর কয়েকবার এইচ.এস.সি. পরীক্ষা দেবার অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে। ক্যানাডাতে আসার পর প্রতিটি কথায় দু’একটা ইংরেজি শব্দ তার ব্যবহার করা চাই। উর্দু, আরবি, আর ইংরেজির যাঁতাকলে বাংলা ভাষার উপরে মাছি বসে থাকে। অ্যানাটমি থেকে অ্যাস্ট্রলজী, রাজনীতি থেকে অর্থনীতি এমন কোন বিষয় নেই যে কাবুল সাহেব কথা বলতে না পারে।
লতা ভাবী আর মতিন ভাই সম্পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে তাদের মেয়ে স্নেহার জন্মদিনের অনুষ্ঠান করছে। স্নেহা এবার ছ’বছরে পা দিলো। তাই কয়েকটি পরিবার এ বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছে। কাবুল সাহেবের স্ত্রী রাতের বেলায়ও বোরকা পরে। বোরকার ভেতর দিয়ে সকলকে সে দেখতে পেলেও তাকে কেউ দেখতে পায় না। এমনকি মহিলারাও নয়। মহিলারা ভেতর ঘরে, আর বসার ঘরে বসেছে পুরুষদের আড্ডা। স্বভাবত কাবুল সাহেবই প্রধান বক্তা। কাজেই সকলকে তার বক্তব্য শুনে যেতে হচ্ছে। অন্য কোন উপায় নেই। আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু সেই বেছে নিয়েছে। সর্বপ্রথমে জন্মদিন পালন ও তার জায়েজ না-জায়েজ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা দিয়ে শুরু। এরপর হারাম হালাল, মদ, বিড়ি, পদ্মার ইলিশ ইত্যাদি সব আলোচনাতেই কাবুল সাহেব বাগাড় দিয়ে যাচ্ছে।
আলোচনা অনুষ্ঠানে সবচেয়ে নীরব শ্রোতার নাম সজীব। ছেলেটি ক্যানাডায় এসেছে মাত্র সাত মাস আগে। সজীবের বোনের স্বামী আর মতিন সাহেব দেশে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। লতা ভাবী আর সজীবের বোনের মধ্যেও ছিল বেশ ঘনিষ্ঠতা। সজীব মাঝেমধ্যে তাই এই বাসাতে বেড়াতে আসে। আজ এসেছে নিমন্ত্রণ পেয়ে। কথার মধ্যে লাফ-ঝাঁপ দেয়া সজীব একদম পছন্দ করে না। এটাই তার ব্যক্তিত্ব। যে কোন আলোচনায় উপস্থিত থাকাকে সজীব লাভজনক মনে করে। হোক সেটা ঘরোয়া কিংবা বিরাট সেমিনার। কেউ যখন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সজীব তার জানা অংশটুকু সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করে না। তার ধারণা যতটুকু সে জানে অতটুকু কেউ না কেউ জানবেই। তাই বসে থাকে অন্যের কাছ থেকে কিছু শিখতে।
কাবুল সাহেব ইতিমধ্যে সজীবের কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। ইতর শব্দটির মানে সজীব জানে না, তবে ঐ-জাতীয় একটা পরিচয় কাবুলের জন্য খুবই মানানসই সে ব্যাপারে সজীব একমত হয়ে যায়। এমন একটি ব্যক্তির উপস্থিতির কারণে বিরক্তিকর পরিবেশে সজীব নিজেকে আটকে রাখতে পারছিল না। মন স্থির না থাকলে চোখও স্থির থাকে না। সজীবের চোখ তাই চলে যাচ্ছিল রান্নাঘরের দিকে। সেখানে লতা ভাবী রান্নাবান্নার শেষ পর্বের ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছেন। সেখানে অন্যান্য ভাবীরাও তাকে সাহায্য করছেন।
সজীবের খুব অপছন্দ জায়গা হলো রান্নাঘর। রান্নাঘরের প্রতি তার একটা ক্ষোভও আছে। ওর মায়ের যাবজ্জীবন জেল হয়েছিল রান্নাঘরে। শলার বেড়া আর ছনের ছাউনিতে গড়া রান্নাঘরেই বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন তিনি। আশ্চর্য ব্যাপার হলো রান্নাঘরেই তার মৃত্যু হয়। একদিন সকালে গরুগুলো খাবার না পেয়ে হাম্বা হাম্বা করে ডেকে চলেছিল। আগুনে পোড়া আমকাঠের গন্ধে ভরে ওঠেনি উঠান। রস জাল দিয়ে যে পায়েস করার কথা ছিল, সেদিন সকালে পায়েসের সেই গন্ধে জেগে ওঠেনি ছেলেমেয়েরা। সজীবের বাবা ফজরের নামাজ শেষে গুড় আর মুড়ির জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে কয়েকটি ডাক দিয়েছিল। তাতে কোন কাজ হলো না দেখে রেগেমেগে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে এলেন। সজীবের মাকে পাবার ঐ একটাই ঠিকানা। ‘সকালবেলা চারটা গুড়মুড়ি খাই তাও সময়মত দিতে পারো না’ কথাগুলো বলা শেষ করে রান্নাঘরে ঢুকেই তিনি চিৎকার দিয়ে ডাক দেন। ‘রাজীব সজীব জলদী আয়। তোদের মা আর নেই’।
সকলে বলেছিল জিন গলা টিপে মেরে রেখে গেছে। বুকের কাপড় হাতের মুঠিতে দলা পাকানো অবস্থায় দেখে সজীব বুঝেছিল এক ফোঁটা পানি না পেয়ে তার মায়ের হৃদযন্ত্র কিভাবে পরিবারটাকে শাসিয়ে গেছে। অথচ জীবিত অবস্থায় সজীবের মায়ের প্রিয় খাবার ছিল পানি। সকলের খাবার পর কলস ভরা পানি খেয়ে তিনি ক্ষুধা নিবারণ করতেন। ভাতের পাতিল নিজের দিকে ঘুরিয়ে এমন কৌশলে ভাত বাড়তেন যেন কেউ জানতে না পারে কি পরিমাণ ভাত বেঁচে আছে। অপচয় করার মত খাবার তাদের ছিল না, একটি ভাত কারোর থালা থেকে পড়ে গেলে সজীবের মা সেটা উঠিয়ে নিজ পাতে রেখে দিতেন। সজীবের মা বলতেন, ঘুম থেকে উঠে সকালে এক মুঠো চাল-পানি গিলে খেলে সমস্ত দিন শরীর হাল্কা থাকে। কাজেকর্মে জোর আসে। তাই তার নিয়মিত নাস্তা ছিল চাল আর পানি। সজীব বড় হয়ে বুঝতে পেরেছিল ইচ্ছে করলে মাও তাদের সাথে পান্তা দিয়ে নাস্তা করতে পারতেন। কিন্তু স্বামী আর পাঁচ পাঁচটি ছেলেমেয়ের মুখে ভেসে ওঠা পেট পুরে খাবার তৃপ্তি দেখেই তার নিজের পেট ভরে যেতো। মাঝেমাঝে হাঁসমুরগি রান্না হলেও মা গলার হাড্ডি ছাড়া অন্য কিছু খেয়েছেন বলে সজীব মনে করতে পারে না। বড় হয়ে সজীব তার বোন লইলির শ্বশুরবাড়িতে একবার বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখে তার বোনও মায়ের মত পাতিলের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ভাত বাড়ছে। এ এক অপূর্ব কৌশল।
মতিন সাহেব এসে বললেন, ডিনার সার্ভ করা হয়েছে। লতা আপনাদের খাবারঘরে ডাকছে। সকলে যেন এই ক্ষণটির অপেক্ষায় ছিল। যে যার মত উঠে দাঁড়ালো। সবার আগে কাবুল সাহেব প্লেট ভর্তি করে চলেছে। রুই মাছ ভাজা, হাঁসের ভুনা মাংস, খিচুড়ি, গরুর কলিজা ভাজি, কাবাব, আরো কত কি। সজীব টেবিল ভরা খাবার দেখে অবাক হয় না। এটাই স্বাভাবিক। কিছু কিছু অতিথি টেবিল ভরা খাবার না দেখলে খুশি হয় না।
লতা ভাবীকে কাছে পেয়ে কাবুল সাহেবে জিজ্ঞেস করলো, এতকিছু রান্না কার কাছ থেকে শিখেছেন? লতা ভাবী উত্তর দিলেন, আমার মায়ের কাছে। একটা প্রশ্ন করে কাবুল সাহেব কখনো খুশি থাকতে পারে না। তাই তার পরের প্রশ্ন, তিনি এখন কোথায়? লতা ভাবী বললেন, আমাদের গ্রামের বাড়ীতে, বরগুনা। সাথে সাথে কাবুল সাহেব বলে উঠল, আপনারা তো বেশ রিচ। ভিলেজে বসে এতকিছু খাবার খান।
সজীব লতা ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল কাবুল সাহেব অজান্তে তার প্রিয় ভাবীকে কোথায় যেন আঘাত করেছে। যে আঘাতে চূর্ণ চূর্ণ হয়ে গেল হাসিমাখা একটি মুখ। ভাবীকে স্বাভাবিক করার জন্য সজীব বলল ভাবী, আজতো লোকজন আর তেমন বেশি কিছু না। আপনিও আমাদের সাথে বসে যান। সাবই মিলে একসাথে খাই। লতা ভাবীও একজন মা। সকলকে না খাইয়ে সে কিছুতেই খাবার ছোঁবে না। সে বলল, না ভাই, তোমরা খেয়ে নাও। আমি পরে বসবো। অমনি কাবুল সাহেব বলে উঠল, আরে ভাই যে মেয়ে রান্না করে তার খিদে থাকে না। লবণ দেখতে দেখতে তার পেট ভরে যায়। আমরা তো খাই সল্ট টেস্টিংএর পর যতটুকু বাঁচে সেটুকু। হা হা হা।
সজীব লক্ষ্য করলো, লতা ভাবীর মুখে এবার সন্ধ্যা নেমে এলো। যে আকাশে চাঁদ নেই তারাও নেই তেমনি ঘন কালো আকাশের মত হয়ে গেল তার মুখখানা। এরকম মুখ সজীব অনেক দেখেছে। একবার নয়, বহুবার দেখেছে। সজীব তবুও চোখ ফেরালো না। লতা ভাবীর অন্ধকার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে সজীব লক্ষ্য করলো ঘন ছায়ার মত কালো ঐ মুখটি ঠিক যেন তার ছোটবোন শেফালীর মত দেখতে। স্বামীর সংসারে অপূর্ব কৌশলে যে খাবার পরিবেশন করার হাত পাকাচ্ছে।
স্কারবোরো, কানাডা