
আবির বাসায় ফিরে তাগদা দিলো –
-আগামীকাল সকালে আমরা বাসা থেকে বের হবো। তারা কে বলো তৈরি হয়ে থাকতে। তুমি ও তৈরি হয়ে নাও। তোমাদের জন্য গাউন কিনতে চেয়েছিলা। সমুদ্রের কাছাকাছি গেলে নীল গাউনের ছবি সুন্দর আসে। তুমি তারা কে নিয়ে শপিং করে আসো।
– আপনি এতো সুন্দর করে চিন্তা করেন কি করে, বলেন তো। আমি তো কখনোই চিন্তা করিনি সমুদ্রে গেলে একটা গাউন পরা ছবি তুলা দরকার। ছেলেরা নাকি এতো কিছু খেয়াল করে না,আপনি এতো খেয়াল করেন কি করে?
-ছেলেরা এতো কিছু খেয়াল করে না,বললেই হলো। সব খেয়াল করে। কিন্তু ইচ্ছে করেই বেখেয়ালি আচরণ করে। আমাদের সিক্রেট কিন্তু বলে দিলাম তোমাকে,হাহাহা।
-দায়িত্ব ঘাড়ে চাপবে তাই বেখেয়ালি সাজে?
-অনেক টা সেইরকম ধরে নিতে পারো।
ভাবী বলেছে আবির কে সময় দেয়ার জন্য। কিন্তু তরু কিছুতেই তারা কে রেখে আনন্দ করতে পারবে না। আবির কে কি ভাবে বলবে মা,মেয়ে যাবে না। মানুষ টা কত কিছু চিন্তা করে রাখে।
আবরি চলে গেলো রান্নাঘরে,পেছনে পেছনে তরুও গেলো- তরু জিজ্ঞেস করলো-
– কিছু লাগবে,আমি করে দেই।
-শ্রীমঙ্গলের সাত রংয়ের চায়ের রেসিপি শিখেছি। একটু ট্রাই করে দেখি কয়টা ল্যায়ার তৈরি করতে পারি।
তুমি তোমার কাজে যাও,চা তৈরি হলে আমি নিয়ে আসবো। আপাতত এখানে এসো না,খুবই নিপুণ হাতে করতে হবে।
তরু মেয়ের রুমে নক করলো। তারা দরজা খুলছে।
-তারা তুমি তৈরি হয়ে থেকো। আমরা আগামীকাল কক্সবাজার যাচ্ছি।
-তোমরা যাও। আমি যেতে পারবো না।
-তুমি মায়ের সাথে কথা শেয়ার করো। তোমার কি সমস্যা? বাবা কি কিছু বলেছে বা এমন কিছু করেছে যাতে তোমার মন খারাপ?
-কে বাবা?
-আবির কে তুমি কি ডাকো?
-মা আমি খুব বিরক্ত হচ্ছি, তুমি যাও আমি প্রয়োজনে নানার বাসায় থাকবো।
-তুমি না গেলে আমি যেতে পারি না। তোমার মামি বলেছিল তাদের কাছে রেখে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া আনন্দ করতে পারি না।
তারা কিছু বলার আগেই তারার এন্ড্রয়েড ফোন টা ভাইব্রেট করছে। তরু দোলনার দিকে তাকিয়ে দেখলো নতুন মোবাইল অথচ তারা কে মোবাইল দেয়া হয়নি।
তরু দ্রুত মোবাইল টা হাতে নিল,যে নাম্বার থেকে ফোন এসেছে সেইভ করা না।
তরুর পায়ের নিচে মাটি সড়ে গেছে। মনে হচ্ছে উপর থেকে কেউ আছাড় দিয়ে ফেলে দিয়েছে।
-তারা মোবাইল কোথায় পেয়েছো?
-আমার না।
-তোমার মোবাইল না,কিন্তু কার মোবাইল?
– আমার এ ফ্রেন্ডের।
-আমার জানামতে প্রিয়ম তোমার বেস্টি। তাছাড়া কোন ফ্রেন্ড নাই। মোবাইল স্ক্রিনে তোমার ছবি কেন?
-আমার সব ফ্রেন্ড কে তুমি চিনবে মা? প্রিয়ম আমার বেস্টি তাই বলে আর কোন ফ্রেন্ড থাকবে না। আমার বাবা তোমার বর ছিল তাই বলে কি সারাজীবন তোমাদের সম্পর্ক ঠিক ছিল । সম্পর্কের বদলাতে পারে না।
তারার কথা শুনে তরুর হাত পা কাঁপছে। এটা কি সেই ছোট্ট তারা। যে মেয়ে টা মায়ের পিছে পিছে ঘুরঘুর করতো! এতো দূরত্ব বেড়ে গেছে মা-মেয়ের অথচ তরু টের-ই পেলো না।
তরুর মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে।
তারার মাথায় হাত রেখে বললো-
-তারা তুমি অনেক বড় হয়ে গেছো। তোমার সাথে আমি আগামীকাল কোন রেস্টুরেন্টে বসে তোমার সব কথা শুনতে চাই।
তারা মাথা নিচু করে বসেছিল। ভেবে ছিলো মা বোধহয় মোবাইল টা নিয়ে যাচ্ছে। তাই দ্রুত মায়ের হাত থেকে মোবাইল টা খপ করে নিয়ে নিল।
তরু ছলছল চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। কোন শব্দ বের হচ্ছিল না।
তরু বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় কোন কিছু কাজ করছে না। তারা চোখের সামনে এমন হয়ে গেলো মাত্র কয়েক টটা দিনের ভিতরে। রাস্তার পাশে
পাশেই একটা কুকুর চারটি ছানা নিয়ে শুয়ে আছে। ছানা গুলো মায়ের শরীরে ঘেঁষাঘেঁষি আর কুই কুই শব্দ করে খেলছে।
তরুদের বিল্ডিংয়ে ডান পাশে বয়েজ হোস্টেল। হোস্টেলের ছাদ থেকে কেউ একজন একটা ছাড়পোকা ধরা কোল বালিশ আর তোষক ডাস্টবিনের পাশে জমতে থাকা ময়লার স্তুপের উপরে ফেলে দিল। এমন প্রায় সময় ই তোষাক,বালিশ,লেপ, কম্বল ফেলাহয়। ধপ্ শব্দ হতেই ছানাগুলো মায়ের বুকে লুকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই দৌড়ে গিয়ে কোল বালিশ আর তোষকের উপর ঘেঁষাঘেঁষি করতে লাগলো।
তরুর মনে কয়েক টা লাইন মনেহলো। কোথায় জেনো শুনেছিল-
যখন তোমার কেউ ছিল না,তখন ছিলাম আমি। এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি।
এটা কি কোন গান ছিল নাকি কবিতা মনে করতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছনে ফিরতেই দেখলো-
আবির চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনটা ল্যায়ার স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তরু চা দেখে অভিভূত হয়েছে ঠিক কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। এতো দ্রুত অনুভূতি বদলানো যায় না। তারার কাছ থেকে অনেক বড় একটা ধাক্কা পেয়ে এসেছে এই তো মিনিট বিশেক আগে। অথচ তরু চাচ্ছে আবিরের উচ্ছ্বাস কে উদযাপন করতে।
জীবনে কোন একটা পাশ অপূর্ণ থেকে যায় কেন। এই যে পূর্ণতা পেলো শুরু হয়ে গেলো আরেক অপূর্ণতার গল্প।