
আমি সব সময়ই রাজনৈতিক সম্পর্কের চেয়ে ব্যক্তি ও পারিবারিক সম্পর্ককে বেশী মুল্য দেই। কারণ রাজনীতি হলো এই সব ব্যক্তি ও পরিবারের সমষ্টিতে যে সমাজ গঠিত হয়, সেই সমাজের কল্যাণে কাজ করার প্রকৌশল। কিন্তু সেই রাজনীতি যদি সমস্টির কল্যাণের পরিবর্তে আরো বেশী বিভেদ, বিভাজন ও বিভক্তি তৈরী করে তাহলে সেই রাজনীতির কোন দাম আমার কাছে নেই। সেই জন্যেই আজ এমন একজন ব্যক্তি নিয়ে দু একটা কথা বলবো যার সাথে আমার রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার তেমন মিল নেই কিন্তু পারিবারিক ও ব্যক্তি সম্পর্কের দাম আছে। অন্ততঃ আমার কাছে আছে। আমার ছোটবেলা বেড়ে উঠেছে উনার এবং উনাদের রাজনীতি দেখে দেখে। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন কিন্তু আমি পছন্দ করতাম জাসদ। তখন আমি ক্লাস ফাইভ ও সিক্সের ছাত্র। সম্ভবত জাসদ তখন প্রতিবাদী বিরোধী দল ছিল, ইংরেজিতে যাকে অপ্পরেসড বলে, সে কারণে। মুলত উনাকে নিয়ে লিখতে গেলে আমি একটি পাঁচশত পাতার বই লিখে ফেলতে পারবো।
গণমানুষের সাথে সম্পর্ক কিভাবে করতে হয়, সেটা আমি কিছুটা তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি। এসব নিয়ে পরে লিখবো। ১৯৮৫ সালে বিরোধী রাজনৈতিক জোট ২২ দলের তীব্র বিরোধিতার মুখে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম উপজেলা নির্বাচনে আমি এবং আমার পরিবার উনার পাশে সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম, যখন উনার দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক বন্ধুরা শুধু মাত্র দলের আজ্ঞাবহের কারণে উনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। বিপুল ভোটে উপজেলা নির্বাচনে তিনি সেবার জয়লাভ করেছিলেন। তার মাত্র একবছর পর উপজেলা নির্বাচন করার কারণে তার দল আওয়ামী লীগ তাকে বহিষ্কার করে, আমি আবারও তাকে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিই। তিনি রাজবাড়ী-১ আসনে ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে রিকসা মার্কা নিয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং আমি সার্বক্ষণিক তাকে সহযোগিতা করি। রিক্সা প্রতীক নিয়ে পা’য়ে হেঁটে গোয়ালন্দ রাজবাড়ী চষে বেড়াই। তখন আমাদের স্বপ্ন ছিল রাজবাড়ী গোয়ালন্দে আমরা একটা ন্যায় নীতির আদর্শ সমাজ গড়ে তুলবো। কিন্তু কিছুদিন পর কিছু বিষয়ে আমাদের মধ্যে মতভেদ শুরু হয় এবং ১৯৯০ সালে এসে আমাকে জনগণ বাধ্য করে তাঁর বিরুদ্ধে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে। এরপর ১৯৯৩ সালে আমি বিদেশে চলে আসি। তিনি আওয়ামী লীগে ফিরে যান, এমপি না হতে পারলেও রাজবাড়ী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আমি দীর্ঘ প্রবাস জীবনে যতবার বাংলাদেশে গিয়েছি অধিকাংশ সময়ে তিনি সহ অনেকের সাথে দেখা করেছি। মনে পড়ে যেদিন আমি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই তার পরদিন যখন বাসা থেকে বের হই, সবার আগে যাই উনার বাসায়, উনাকে সালাম করতে। আমি বিশ্বাস করতাম গনতান্ত্রিক সহনশীলতার রাজনীতি। ‘রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে শত্রুতা নয়’ নীতিতে বিশ্বাস করতাম এবং প্রথম সুযোগেই তা প্রমাণ করার চেষ্টা করতাম। এছাড়া ছোটবেলায় অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে যা ভোলার নয়। যখনই বাসার সামনে দিয়ে তিনি যেতেন, কাকী কাকী বলে আমাদের বাসায় ঢুকে যেতেন, আমার ছোট ভাই হেনাকে কোলে তুলে নিতেন এবং যতদুর দেখেছি মা এবং আব্বা দুজনই তাকে অনেক স্নেহ করতেন। না খেয়ে কম সময়ই আসতে পেরেছেন তিনি। এসব কথা ডিটেইলস লিখলে অনেক বড় লেখা হয়ে যাবে।
এলাকায় তিনি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় অবদান রেখেছেন। তিনি যখন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ছিলেন, আশা করেছিলাম তিনি তার নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজটির পাশাপাশি আমাদের কলেজটিকেও গড়ে তুলতে সহযোগিতা করবেন। আমি এমপি বা জেলা চেয়ারম্যান হলে তাই করতাম। ভাই হয়তো সে সুযোগটা পান নি। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে যেদিন তার শেষ দিন সম্ভবত তার একদিন আগে তার সাথে আমার দেখা হলো। আবারও স্মরণ করিয়ে দিলাম, ভাই দরখাস্ত দিতে বলেছিলেন, জমা দিয়েছি কিন্তু কিছুই পাই নি এখনো। ভাই বললেন, কি বলবো হালিম, এই জেলার এমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা মসজিদ মাদ্রাসা নাই, যেখানে আমি জেলা পরিষদ থেকে অনুদান দেই নি, শুধু তোর কলেজটি বাদে। মনের কষ্ট মনে নিয়ে শুধুই মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম ভাইয়ের দিকে। আরো কিছু মনোবেদনা রয়েছে যা তাঁর সাথে দেখা হলে একদিন হয়তো বলবো।
গত দু মাস আগে দেশে গিয়ে তার সাথে সেভাবে দেখা হয় নি তবে আমার ছোট ভাইয়ের জানাজায় এসেছিলেন। অনেক নেতাই আসেন নি, তিনি এবং বিএনপি নেতা আলী নেওয়াজ খৈয়াম ভাই ও জামাত নেতা এ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম ভাই এসেছিলেন। শুনেছিলাম তিনি কিছুটা অসুস্হ্য। বয়স অনেক হয়েছে। আওয়ামী লীগ করলেও কারো উপর কখনো চড়াও হন নি। বালুমহাল, নদী নালা খাল বিল দখল করতে শুনি নি। শুনি নি কখনো পেটোয়া বাহিনী পুষতে কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপর হামলা মামলা করতে। ছোট বড়, গরীব ধনী সকলের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, তা শিখেছিলাম উনার কাছ থেকে। তিনি আর কেউ নন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকীর আব্দুল জব্বার। আজ ফেসবুকে দেখলাম তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জানি না, তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কী অভিযোগ রয়েছে! তবে সবমিলিয়ে তাকে গ্রেফতার করার কারণ হিসেবে শুধু কোটা পূরণ করা ছাড়া আর কিছুই আমি দেখি না। অপরাধীরা শাস্তি পাক সবাই আমরা চাই কিন্তু সমাজটাকে টিকিয়ে রাখতে চাইলে ভিন্নমতের রাজনীতি করলেই তাকে গ্রেফতার করার পুরনো ফ্যাসিবাদী কৌশল ফলো করলে সেটা হবে মারাত্মক ভুল। মনে রাখা দরকার রাজনীতিই সব নয়, মানুষ ও পরিবার, সম্পর্ক এসব যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে সেটা হবে পোকামাকড়ের ঘরবসতি, মানুষ্য বসবাসের অযোগ্য। আমি দলীয় চিন্তার উর্ধে উঠে তুলনামূলক একজন শান্তিপ্রিয় নেতা হিসেবে, গণমানুষের একজন বন্ধু হিসেবে, এলাকার অন্যতম একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে বয়োবৃদ্ধ অসুস্হ্য রাজনীতিক ফকীর আব্দুল জব্বার ভাইয়ের আশু মুক্তি কামনা করছি।
স্কারবোরো, কানাডা