
ভ্যান গাড়িটি বহুসময় ধরে ঢাকার যানজট পার হয়ে পদ্মা নদীর পারে এসে দাঁড়ালো। কত মানুষের কত প্রশ্ন কার লাশ গাড়িতে? কী নাম মানুষটির? কবে উদ্ধার হলো? জীবিত নাকি মৃত পাওয়া গেছে? গফুর মিয়ার এসব প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছে করে না। মুখ তেতো হয়ে আসে। উৎসুক জনতা উঁকিঝুঁকি দেয় যদি গাড়িটির আয়না দিয়ে ভেতরের কিছু দেখা যায়। অবশেষে গাড়িটি পদ্মা পার হলো। গাড়িটি ছুটে চলেছে।
শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে। দিনের আলোও প্রায় মিলিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। গফুর মিয়া কিছুক্ষণ পরপরই গাড়ি চালককে বলছেন, ‘ভাই একটু জোরে চালান গাড়িটা, রাত হইয়া গেলে কবরে নানা সমস্যা হইবো। ’ গ্রামের এবরো থেবরো রাস্তা দিয়ে বেশি জোরে গাড়ি চালানো সম্ভব হয় না। গ্রামের ভেতর যখন ঢোকে গাড়িটি তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
দূরের বাড়িগুলোতে মৃদু আলোর রশ্নি দেখা যাচ্ছে। দুই পাশের বাঁশঝাড়গুলো কেমন যেন স্বব্ধ হয়ে গফুর মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এই সন্ধ্যাবেলা কী পাখি এটা? মরা ডালটার উপর বসে গফুর মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে? গফুর মিয়ার কেমন যেন ভয় লাগতে থাকে। পেছন থেকে নয়নের গলা শোনা গেল, ‘চাচা আমরা কি গ্রামে ঢুকছি?’ কে? কে?
এটা তো নয়নের গলা। নয়ন তো মরে গেছে। ওর মৃত দেহ বরফ চা পাতা দিয়ে বাক্সে ঢুকানো হয়েছে। তাহলে কে কথা বললো? গফুর মিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় গাড়ির চালককে জিজ্ঞেস করেন,‘ভাই আপনি কি কারো কথা শুনতে পাইছেন?’ গাড়ির চালক মাথা নাড়ে, সে শুনতে পায়নি। গফুর মিয়া বুঝতে পারে এটা তার মনের ভুল। তিনি দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দেন।
এই তো একবছর আগে গফুর মিয়া নয়নকে নিয়ে ঢাকায় আসে কোনো একটা কাজে ঢুকিয়ে দেবার জন্য। অভাবের সংসার। নয়নের বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে চার বছর থেকে। যা একটু আধটু জমি-জমা ছিল তাও নয়নের বাবার চিকিৎসা, সংসারের খাওয়া পরায় নেমে এসেছে শূন্যের খাতায়।
নয়ন দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও তার এসএসসি পরীক্ষাটা আর দেয়া হলো না অর্থের অভাবে। নয়নের মা এবাড়ি-ওবাড়ির কাঁথা সেলাই করে। মুন্সি বাড়িতে কাপড় কাচে, মসলা বাটে। কিন্তু তাদের তো এত খারাপ অবস্থা ছিল না, যতদিন নয়নের বাবা সুস্থ ছিল। নয়নের কান্না পায় মায়ের এমন কষ্ট দেখে। ছোটবোন টুনি স্কুলে যায় কিন্তু কতদিন যেতে পারবে কে জানে? নয়ন গ্রামে এদিক-সেদিক ছোটখাট কাজ করে।
গফুর মিয়া ঢাকা শহরে ছোটখাট ব্যবসা করে। দুই তিন মাস পর পরই গ্রামে আসে। নয়ন গফুর মিয়াকে ধরে বসে, ‘চাচা ঢাকা শহরে আমার একটা কাজ জোগাড় কইরা দেন, মায়ের এত কষ্ট আমার আর সহ্য হয় না। ’ নয়ন আর নয়নের মায়ের অনুরোধে গফুর মিয়া নয়নকে নিয়ে রওয়ানা হয় ঢাকার পথে। বাসে বসে নয়নের কত প্রশ্ন করে গফুর মিয়াকে, ‘চাচা ঢাকার মানুষ কেমন? আমি একটা কাজ পামু তো চাচা?’
গফুর মিয়া জবাব দেয়, ‘চিন্তা করিস না একটা ব্যবস্থা হবেই। আমার পরিচিত মানুষ আছে গার্মেন্টস-এ, তোকে ঢুকাইয়া দেবো।’ নয়নের চোখ চিক চিক করে উঠে খুশিতে। আবার প্রশ্ন করে গফুর মিয়াকে, ‘চাচা আমি পারমু তো সেলাইর কাজ করতে? এটা তো মেয়ে মানুষের কাজ।’ বলে নয়ন নিজে নিজেই হাসে। গফুর মিয়া নয়নকে আশ্বস্ত করে, ‘পারবি পারবি, ওরা ট্রেনিং দিয়া নিবে। ’
নয়নকে পোশাক শ্রমিক হিসাবে পোশাক কারখানায় ঢুকিয়ে দেন গফুর মিয়া পরিচিত একজনকে বলে। নয়ন দুই মাস ট্রেনিং নিয়ে নিয়মিত কাজ শুরু করে। মাসের শেষে টাকা পেয়ে মাকে পাঠিয়ে দেয়। ওর বড় শান্তি লাগে ভেবে, সে রোজগার করে সংসারের দায়িত্ব নিতে পেরেছে। কাজ শুরু করার পর নয়ন তার মাকে চিঠি লিখে পাঠায় গফুর মিয়ার হাতে।
মাগো,
কেমন আছো তোমরা? বাবা কেমন আছে? আমি ভালো আছি মা। গফুর চাচা আমাদের বড় উপকার করলো। এই কাজটা না পেলে আমাদের কষ্ট বেড়েই চলতো। আমি অনেক খুশি মা। গফুর চাচা কারখানার আরো কয়েকজনের সাথে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। উনারা অনেক ভালো, আমাকে অনেক স্নেহ করেন। আমরা সবাই মিলে রান্না করে খাই। মা, তুমি বোধহয় শুনে হাসছো, আমি কী করে রান্না করি। পারি মা সবই পারি, প্রয়োজনে সবই করতে হয়। আমি জানি মা আমার জীবনটা শ্রমিকের হলো বলে তোমার কষ্ট হচ্ছে। তোমার সখ ছিল আমি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে অফিসে চাকরি করবো।
কিন্তু মা তুমি জানো না এই কাজ অনেক সম্মানের। আমরা বিদেশের কত বড় বড় কোম্পানির পোশাক তৈরি করি। সেখান থেকে কত কত বিদেশী মুদ্রা পায় আমাদের দেশ। দেশে কত উন্নতি হচ্ছে। মা একটা মহৎ কাজ আমরা করছি। মালিকদের ব্যবহার ভালো না। তাতে আমি কিছু মনে করি না। ওরা বোঝে না আমরা কাজ না করলে ওরা বড় লোক হবে কী করে? অনেক কথা লিখলাম মা। তুমি মুন্সিবাড়ির কাজটা ছেড়ে দিয়েছো তো? মুন্সির বউয়ের দুর্ব্যবহার তোমার আর সইতে হচ্ছে না তো মা? গফুর চাচা আবার যখন আসবে তখন তোমার জন্য মোবাইল কিনে পাঠাবো। তাহলে তোমার সাথে প্রাণ ভরে কথা বলতে পারবো। আরেকটু পয়সা হাতে আসলে বাবাকে ঢাকায় এনে ডাক্তার দেখাবো। টুনির দিকে খেয়াল রেখো।
ইতি তোমার নয়ন।
নয়ন ঠিকই তার মায়ের জন্য মোবাইল কিনে পাঠিয়েছিল। এই তো তিন চারদিন আগেই তো নয়ন গফুর মিয়াকে বলেছিল, ‘চাচা আজকে মায়ের সাথে অনেক কথা কইলাম। আগামী মাসে এক সাপ্তাহ ছুটি নিয়া বাড়িতে থাইকা আসুম। ঘরটাও ঠিক করাইতে হইবো। মা কইলো বৃষ্টি হইলে নাকি চাল দিয়া অল্প অল্প পানি পড়ে।’
নয়নের বাড়ি যাওয়া আর হলো না। রানা প্লাজার ধ্বসের খবর পেয়ে গফুর মিয়া ছুটে এসেছেন। নয়ন তো এখানকার পোশাক কারখানাতেই কাজ করে। সারাদিন গফুর মিয়া দাঁড়িয়ে থাকলেন সেখানে। নয়নের কোনো খোঁজ পেলেন না। খোঁজ পেলেন না তার সহকর্মীদেরও। ততক্ষণে এই দুর্ঘটনার খবর পৌঁছে গেছে গ্রামেও। গফুর মিয়া পরদিন ফজরের নামাযের পর আবার নয়নের একটা ছবি যোগাড় করে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন ধ্বংসস্তূপরে সামনে। কয়েকজন করে করে বের করা হচ্ছে ধ্বংসস্ত‚প থেকে।
প্রতিবারই গফুর মিয়া ছুটে যান দেখতে, এই বুঝি নয়ন এলো। অবশেষে নয়নকে খুঁজে পেলেন তিনি। উদ্ধারকারীরা চিৎকার করে বললো, এখনো নিশ্বাস আছে ছেলেটার, এ্যাম্বুলেন্সে উঠাও। গফুর মিয়া ছুটে যান। এই তো, এই তো নয়ন। গফুর মিয়া চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘নয়ন দেখ চোখ খুইলা, আমি তোর গফুর চাচা।’ নয়ন একটু চোখ খুলে বিড়বিড় করে বলে, ‘গফুর চাচা আমারে মায়ের কাছে নিয়া চলেন।’ এই ছিল নয়নের শেষ কথা। এ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যু হয় নয়নের। এই তো নয়নের মৃতদেহ নিয়ে এই পথেই ফিরে চলেছে, গফুর মিয়া। যে পথ দিয়ে একদিন নিয়ে চলেছিল ঢাকায় কাজের জন্য। ভ্যান গাড়িটি বাড়ির কাছে এসে গেল। ভিতরের উঠানে শোনা যাচ্ছে বহু মানুষের কণ্ঠ। গাড়ি বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই একটি আর্তনাদে পৃথিবী যেন মুহূর্তের মধ্যে থেমে গেল, ‘বাপজান তুই আইছস…।’
[২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধ্বসে শত শত শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল। সেই শত শত শ্রমিকের মধ্যে একজন শ্রমিকের জীবন নিয়ে আমার এই লেখাটি]
ম্যাল্টন, কানাডা