3.6 C
Toronto
মঙ্গলবার, এপ্রিল ১, ২০২৫

অপূর্ব কৌশল

অপূর্ব কৌশল - the Bengali Times
জীবিত অবস্থায় অবস্থায় সজীবের মায়ের খাদ্য তালিকার অন্যতম ছিল পানি

… সজীবের খুব অপছন্দ রান্নাঘর। রান্নাঘরের প্রতি তার একটা ক্ষোভও আছে। তার মায়ের জীবনটা শেষ হয়ে গেছে এই রান্নাঘরে। কবুল উচ্চারণ করার অপরাধে তার মায়ের যাবজ্জীবন জেল হয় রান্নাঘরে। ছনের ছাউনিতে গড়া রান্নাঘরেই জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন সজীবের মা। সেখানেই তাঁর মৃত্যু।

একদিন সকালে গরুগুলো খাবার না পেয়ে হাম্বা হাম্বা করে ডেকে চলছিল। আগুনে পোড়া আম কাঠের গন্ধে ভরে ওঠেনি সেদিন বাড়ির উঠান। রস জাল দিয়ে যে পায়েস করার কথা ছিল সেই গন্ধে জেগে ওঠেনি ছেলেমেয়েরা। সজীবের বাবা ফজরের নামাজ শেষে গুড় আর মুড়ির জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে কয়েকটি ডাক দিয়েছিল। তাতে কাজ হলো না দেখে রেগে মেগে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে এলেন। সজীবের মাকে পাবার ঐ একটাই ঠিকানা।

- Advertisement -

‘সকাল বেলা চাইরটা হুড়ুম খাই তাও সময়মত দিতি পারো না’?

কথাগুলো বলতে বলতে রান্নাঘরের ভেতর ঢুকেই তিনি চিৎকার দেন, ‘সজীব মজিদ জলদী আয়। তোদের মা নাইরে’।

কেউ বলেছিল জিন গলা টিপে মেরে রেখে গেছে। কেউ বলে, শরীর নীল হওয়া মানে বদ জিন এসেছিল। সজীব লক্ষ্য করলো তার মায়ের হাত বুকের কাছে। শাড়ীটা দলা পাকানো। সে বুঝেছিল হার্ট এটাক। একফোঁটা পানি না পেয়ে তার মা কত কষ্ট পেয়ে গেছে।

জীবিত অবস্থায় অবস্থায় সজীবের মায়ের খাদ্য তালিকার অন্যতম ছিল পানি। সকলের খাবার পর কলস ভরা পানি খেয়ে তিনি ক্ষুধা নিবারণ করতেন। ভাতের পাতিল নিজের দিকে ঘুরিয়ে এমন কৌশলে ভাত বাড়তেন যেন কেউ জানতে না পারে কতটুকু ভাত আছে পাতিলের ভেতর। অপচয় করার মত খাবার তাদের ছিল না। একটি ভাত পড়ে গেলে সজীবের মা সেটা উঠিয়ে নিজ পাতে রেখে দিতেন। সজীবের মা বলতেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে এক মুঠো চাল-পানি গিলে খেলে সমস্ত দিন শরীর হাল্কা থাকে। কাজকর্মে জোর আসে। তাই তাঁর নিয়মিত নাস্তা ছিল চাল-পানি।

সজীব বড় হয়ে বুজতে পেরেছিল ইচ্ছে করলে মাও তাদের সাথে নাস্তা করতে পারতো। কিন্তু স্বামী আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মুখে ভেসে ওঠা খাবারের তৃপ্তি দেখেই তাঁর পেট ভরে যেতো। মাঝেমাঝে হাঁসমুরগি রান্না হলেও মা গলার হাড্ডি ছাড়া অন্য কিছু খেয়েছেন বলে সজীব মনে করতে পারে না।

সজীব একবার তার বড় বোন লইলির শ্বশুরবাড়ি বড়াতে গিয়েছিল। সেখানে গিয়েও দেখে তার বোন মায়ের মত পাতিলের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে ভাত বাড়ছে। এ এক অপূর্ব কৌশল।

এদিকে মতিন সাহেব, মানে হোস্ট এসে বলল লতা আপনাদের ডাকছে। সকলে যেন এইক্ষণটির অপেক্ষা করছিল। তারা যে যার মত উঠে দাঁড়ালো। সবার আগে নেতা গোছের সেই লোকটা মানে কাবুল সাহেব প্লেট ভর্তি করে চললেন। রুই মাছ, ভুনা হাঁস, খিচুড়ি, কলিজা ভাজি, কাবাব আরো কত কি। সাজানো টেবিল দেখে সজীব অবাক হয় না। বিদেশের বাড়িতে এটাই স্বাভাবিক। লতা ভাবীকে সেই কাবুল সাহেব জিজ্ঞেস করলো ‘এতকিছু রান্না কার কাছে শিখলেন’? লতা ভাবী উত্তর দিলেন, আমার মায়ের কাছে।

কাবুল সাহেবের পরের প্রশ্ন, ‘তিনি কি এখানেই থাকেন’?

লতা ভাবী বললেন, না আমার মা বাংলাদেশে। গ্রামের বাড়ীতে থাকেন।

সাথে সাথে কাবুল নামের লোকটি বলে উঠল, ‘আপনারা তো বেশ রিচ, ভিলেজে বসে এতকিছু খাবার খান’।

সজীব লতা ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল কাবুল সাহেব অজান্তে লতা ভাবীকে যেন কোথায় আঘাত করেছে, সে আঘাতের চিহ্ন তার মুখের উপর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সজীব বলল, আজতো তেমন বেশি লোক নেই, ভাবী আপনিও নিয়ে নেন না। লতা ভাবীও একজন মা। সকলকে না খাইয়ে সে কিছুই ছোঁবে না। তার গলাটা ধরে আছে। সে বলল না ভাই, তোমারা খেয়ে নাও আমি পরে খাব।

অমনি কাবুল সাহেব আওয়াজ দিয়ে উঠলো। ‘আরে ভাই যে মেয়ে রান্না করে তার খিদে থাকে না। লবণ দেখতে দেখতে তার পেট ভরে যায়। আমরা তো খাই সল্ট টেস্টিং এর পর যতটুকু বাঁচে তাই – হা হা হা।

সজীব লক্ষ্য করলো যে আকাশে চাঁদ নেই তারা নেই তেমনি ঘন কালো হয়ে গেছে লতা ভাবীর মুখ। এরকম মুখ সজীব অনেক দেখেছে। একবার না বহুবার দেখেছে। সজীব মোটেও অবাক হয় না। সে লক্ষ্য করলো এই মুখ একেবারে তার ছোটবোন শেফালির মত দেখতে। স্বামীর নতুন সংসারে অপূর্ব এক কৌশলে যে খাবার পরিবেশন করতে হাত পাকাচ্ছে…

 

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles