
আজকে একটু আগে অন্টারিওর দক্ষিণ পশ্চিমের এক ছোট্ট শহরে এসে আছি । নিরিবিলি কিছু সময় আছে হাতে।
ভাবলাম , অনেকের দীর্ঘদিনের একটা প্রশ্নের উত্তর দেই।
প্রশ্ন ঠিক নয় , কৌতূহল বলাই ভালো , কেন আবার আমি এই পেশা বেছে নিলাম।
সোজা সাপ্টা বললে বলতে হয় , মানুষের গল্প শোনার আগ্রহ থেকেই এটিকে আমি বেছে নিই। প্রতিটি কেসের সঙ্গে থাকে একেকটি গল্প, এবং পেশাগত ভাবে এই কাজটি করে কাউকে কানাডায় আসার লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করতে পারাটাই বা কম কিসে। কাজটা ঠিকমতো হয়ে গেলে চমৎকার একটা অনুভূতি হয়। যাদের জন্য করা, তাদের জীবনের পথে এটি হয়তো একটি ক্ষুদ্র অবদান, কিন্তু জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবার মতো ।
এই পেশার একটা মানবিক দিকও আছে । বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার —বাংলাদেশের মতো সংঘাতসংকুল জনপদ থেকে পালিয়ে আসা পরিবার, বা পেশার লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে আসা কোনো দক্ষ পেশাজীবী , কিংবা উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসা কোনো ছাত্র বা ছাত্রী । বা এমনও হয়, কেউ দেশে বিয়ে করে ফিরেছেন , এক্ষেত্রে যিনি কানাডার অভিবাসী , তিনি স্পাউস বা পার্টনার এর স্পনসর ।
ইমিগ্রেশন এর ব্যাপারটা খুবই পরিবর্তনশীল , এর ধরনটাই এমন। সরকারের খেয়ালের পরিবর্তন , কখনো জনমত পরিবর্তন আর সেই থেকে পলিসির পরিবর্তন বা আইনের পরিবর্তন।
তাই কানাডার ইমিগ্রেশন ল ও পলিসি যেন একটি জটিল, পরিবর্তনশীল ধাঁধার মতো—যার জন্য নিখুঁত কারিগরি দক্ষতা দরকার তো বটেই , সেই সাথে সৃজনশীলতা। সমস্যা সমাধানের জন্য এ দুটোর বিকল্প নেই। তাই কাজের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত শিখছি ।
প্রতিটি পরিবর্তন—হোক সেটা এক্সপ্রেস এন্ট্রির স্কোরিং নিয়ে , বা মন্ত্রীর নতুন নির্দেশনা, বা সাম্প্রতিক সময়ের পাবলিক পলিসির মতো কিছু—প্রতিবার নতুন করে গোয়েন্দার মতো এর জটিলতা বুঝতে হয়। তারপর ক্লায়েন্টদের ওপর এর কি প্রভাব হতে পারে, সেটা নিয়ে যখন অ্যানালিসিস করি , সেই সময়টা ও বেশ উদ্দীপনার । অনেকটা তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগের মতো।
সরকারের সব পরিবর্তন যে ভালো লাগে , তা নয় , কিছু পরিবর্তন নিয়ে আমার দ্বিমত আছে —যেমন টেম্পোরারি ইমিগ্রেশন এর ওপর সরকারের অতিরিক্ত নির্ভরতা, অথচ পার্মানেন্ট রেসিডেন্সির কোনো নিশ্চয়তা নেই । এসব নিয়ে ক্লায়েন্টরা হতাশ হয়ে পড়ে, সেই হতাশা আমাকেও সংক্রমিত করে।
এমন দিন আসেই , যখন ক্লায়েন্ট এর আবেদন প্রত্যাশা মতো হয় না , অনেক ভালো আবেদনের পর ও প্রত্যাখ্যাত হয়। সেদিনগুলো যেন কাটতে চায় না , হতাশা এসে ভর করে , তারপর যদি মেরিট থাকে বা ক্লায়েন্ট চায়, তবে পুনঃনির্ধারণের বা সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার আবেদন জানাই , আবার পজিটিভ ডিসিশন আসে। এই ছোট ছোট ইতিবাচক প্রভাবগুলোই আবার আমাকে কাজটিতে ধরে রাখে ।
তবে এটা স্বীকার করতে বাধা নেই , এই পেশার কিছু অপ্রিয় বাস্তবতা ও সমালোচনা আছে। ইমিগ্রেশন বিভাগের কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে সমালোচনা আছে , আছে ডিসিশনে অসঙ্গতি নিয়ে। অনেক সময় উপায় থাকে না বলে মেনে নিই , কিন্তু মনে নিতে পারি না । যেমন , দীর্ঘ প্রসেসিং সময় , যা ক্লায়েন্টদের জন্য অপ্রয়োজনীয় দুর্ভোগ নিয়ে আসতে পারে।
এতোদিনে বুঝে গেছি, অভিবাসন আইন দুর্বলচিত্তের জন্য নয়; এটিতে লাগে ধৈর্য, এবং খাপ খাইয়ে নেবার ক্ষমতা। অনিশ্চয়তাকে মেনে নিয়েই এই কাজটি করতে হয় । তাই অনিশ্চয়তার প্রতি সহনশীল না হয়ে এ পেশায় উপায় নেই।
টরন্টো, কানাডা